বাবাজী মহারাজের সঙ্গে অন্য সন্ন্যাসীর পার্থক্য – তিনি শুধু একজন সাধু, দার্শনিক বা সমাজ-সংষ্কারক নন, তিনি এক নতুন মতবাদের প্রবক্তা।

 


 ব্রম্ভ সত্য, জগৎও সত্য। জগতকেও বাদ দেওয়া যাবে না, আবার ভগবানকেও বাদ দেওয়া যাবে না। পরাবিদ্যার জন্য অপরাবিদ্যার দরকার, কিন্তু মনে রাখতে হবে শ্রীভগবানকে লাভ করার জন্য জাগতিক বিদ্যার দরকার। 

 

তারক ঘোষ

 

ড. স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া ছিলেন গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭৬ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সর্বচ্চ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন। ১৯৭৮ সালে হায়ার সেকেন্ডারী উত্তীর্ণ হলেন আবার সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। ইচ্ছা ছিল ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে উচ্চ-শিক্ষা শুরু করা। নিয়েও ছিলেনভর্তি হয়েছিলেন বর্ধমানের রাজ কলেজে।  কিন্তু পরে তিনি ইংরাজী ছেড়ে দর্শনশাস্ত্রে সাম্মানিক নিলেন।

১৯৮১ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে দর্শন শাস্ত্রে সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক হলে রাজ কলেজ থেকে। এবার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৫ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম হয়ে শেষ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা।

এরপর কী? তার গুরুদেব শ্রীজানকীদাসজী তাকে বলবেন গবেষণা করার কথা। কারণ, শ্রীজানকীদাসজী বুঝে গিয়েছিলেন, তার এই শিষ্য সাধারণ শিষ্য নন, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে, এক ধর্ম ও সমাজ-সংষ্কারী মন। 

তাই, শিষ্যকে একান্তে বলেছিলেন – ‘তুই গবেষণা শুরু কর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। 


বইটি কিনতে উপরের ছবিটিতে ক্লিক করুন। সরাসরি প্রকাশকের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন 


বাবাজী মহারাজ গুরুজীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, গবেষণার বিষয় কী হবে। শ্রীগুরু তখন তার প্রিয় এই শিষ্যকে বললেন এমন একটা বিষয়, যা শুনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন হতভম্ব। অনুমতি কিছুতেই মেলে না। 

 জ্ঞানতপস্বী সাধক স্বামী জানকীদাসজী মহারাজের শিষ্য প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া যখন সমাজতত্বের এক দূরূহ বিষয় নিয়ে গবেষণায় পরিকল্পনা করেন তখন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসন চলছে। বামপন্থীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার দাপটে তখন রাজ্যে বাঘে গরুতে জল খাচ্ছে। 

এইরকম অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাবাজীর পেশ করা গবেষণার বিষয় নিয়ে মত দিতে পারছে না। কারণ, তারা বুঝতে পারছে না, সরকার যদি, কোন কারণে রুষ্ট হন। বাবাজীও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি হাল ছাড়লেন না। 

বারবার একই বিষয় নিয়ে আবেদন-নিবেদন করতে লাগলেন। কিন্তু, অনুমতি আর পাওয়া যায় না। বাবাজী মহারাজের বিষয় নির্বাচনকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়বাবাজীকে বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। বাবাজী আবার গুরুজীর কাছে দাঁড়ালেন।




 শ্রীগুরুর সাফ জবাব, - ওই বিষয়টাই হবে প্রজ্ঞাদাসজীর একমাত্র বিষয়। দাদাজী মহারাজ তার শিষ্যের গবেষণার বিষয় ঠিক করে দিয়েছিলেন – ‘বেদান্তের আলোকে মার্ক্সবাদ।

বাবাজী যখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার গবেষণার বিষয় জানালেন এবং তার গুরুদেবের ইচ্ছার কথা জানালেন, কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিলেন –‘তোমার গুরুজী দেখছি বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খাওয়াতে চাইছেন। 

বাবাজী ফিরে এসে আবার শ্রীজানকীদাসজীকে জানালেন সেকথা। আর সেই কথা শোনামাত্রই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন শ্রীজানকীদাসজী।

 শিষ্যকে বললেন –‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাও, তুমি গুরু নির্দেশিত বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় নির্বাচন করতে পারবে না। বাবাজী মহারাজ সেই কথাই গিয়ে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ, তার শ্রীগুরু বাঘে বলদে এক ঘাটে জল না খাইয়ে ছাড়বেন না। 

 



 অবশেষে বহু টালবাহানার পর মিলল অনুমতি। বেদান্তের আলোকে মার্ক্সবাদনিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাপত্র রচনায় মন দিলেন  সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াডঃ অমরনাথ ভট্টাচার্যের তত্বাবধানে শুরু হল গবেষণার কাজ। 

একদিকে, মার্কসবাদ ও অন্যদিকে নিম্বার্কবাদ- দুটি ভিন্নমুখী ও ভিন্ন-চিন্তাধারাকে তিনি নিয়ে এলেন এক মঞ্চে। এটা এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছিল ওই ছাত্র জীবনে। কেননা, তিনি ছাত্র-জীবন থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, তার পথ হবে সমাজের মঙ্গল সাধনের পথ। 

কিন্তু, কেন বাবাজী এই দুটি বিষয়কে বেছে নিয়েছিলেন? যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তার কারণ, তার আধুনিক সমাজ-চেতনা। তিনি বুঝেছিলেন, ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা পেতে হলে, সাম্যবাদ প্রয়োজন। আবার ধর্মকে বাদ দিয়ে সাম্যবাদ আনার চেষ্টা করলে, তার ফল ভালো হয় না। অন্তরে সন্ন্যাসী এই ছাত্রের তপস্যা ছিল মানুষের জন্য তথা এই মানব-সমাজের জন্য এমন কিছু করা, যা সার্বিক মঙ্গল করবে সমগ্র সমাজ-ব্যবস্থার। বদলে যাবে, ভারতীয় সমাজের প্রচলিত ফর্মূলা। আর এইখানেই তার সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য। ১৯৯১ সালে, সমাজবিজ্ঞানের এই ছাত্র লাভ করলেন ডক্টরেট। তার এমএ ডিগ্রির সঙ্গে যুক্ত হল- পিএইচডি ড.প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। এখন দেখা যাক, এই বিষয়টা নিয়ে কেন এত আগ্রহ ছিল শ্রীজানকীদাসজীর। 


শ্রীজানকীদাসজী বলছেন –“ছাত্রজীবন থেকেই কার্ল মার্কস ও তাঁর নীতির প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে মার্কসবাদী অর্থনৈতিক নীতিগুলি পৃথিবীতে স্বর্গ নিয়ে আসতে পারে এবং সমাজের সমস্ত মানুষের সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির গ্যারান্টি দিতে পারে। আমি মনে করি, মার্কসবাদের ভিত্তি প্রস্তর হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। যা জগতকে কঠিন বাস্তবতা হিসাবে গ্রহণ করে এবং এর বাইরে কিছুই নয়। মার্কসবাদ ঈশ্বর, আত্মা বা সার্বজনীন ধর্মের জন্য কোনও বিশেষ জায়গা তৈরি করেছে কিনা তা নিয়ে আমার অনেক সন্দেহ রয়েছে। 

একজন ভারতীয় হিসাবে আমি সনাতন ধর্মের পথ অনুসরণ করে আমার জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। বেদান্ত দর্শন অধ্যয়ন করার সময় আমি শঙ্করের চরম অদ্বৈতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম যা জগতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং ব্রম্ভাকেই একমাত্র বাস্তব হিসাবে স্বীকার করে। যেহেতু চরম অদ্বৈতবাদের মতবাদ আমাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তাই আমি সত্যের সন্ধানে বেদান্ত দর্শনের অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম এবং শ্রী স্বামী নিম্বারকাচার্য মহারাজের দ্বৈতাদ্বৈত বা দ্বৈতবাদী অ-দ্বৈতবাদের মতবাদের সংস্পর্শে এসেছিলাম। 

ভগবান নিম্বার্কের দেওয়া শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলির বিস্ময়কর যুক্তি এবং অনন্য ব্যাখ্যায় আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনই জগতও সত্য।  এই শিক্ষা আমাকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। 

 



 সঠিক শিক্ষার অভাব একটা জাতিকে পিছনে ফেলে দিতে পারে। সমাজে শিক্ষিত, কুসংষ্কারমুক্ত মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, সমাজ হয়ে উঠবে শক্তিশালী। এই সমাজের স্বপ্ন বাবাজী দেখতেন বলেই হাত দিয়েছিলেন এমন একটা গবেষণায়, যে গবেষণার ফসল, ভবিষ্যত সমাজের একটা মডেল। বাবাজী বলছেন – “The transformation of human society through dialectical materialism and class struggle is nothing but transformation of Real man-ship to a True man-ship.”  তিনি তাই বলছেন –“Human being is an organ of human society.” তিনি বলছেন –“ মার্ক্স বলেছেন কম্ম্যুনিস্ট শাসনে ‘State will be withered away.’ মার্ক্সের সাম্যবাদের চিন্তা ভারতে নতুন কিছু নয়। আর ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে, ধর্মকে বাদ দিয়ে সাম্যবাদ আনার চেষ্টা ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখী হতে পারে।




ড. স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া, এম.এ. পি. এইচ.ডি. তিনি যদি শুধুমাত্র সন্ন্যাসী হতেন বা শুধু ধর্মের গন্ডীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন, তাহলে রাতের পর রাত জেগে গবেষণা চালিয়ে যেতেন না। তার সঙ্গে অন্য সন্ন্যাসীর পার্থক্য তিনি শুধু একজন সাধু, দার্শনিক বা সমাজ-সংষ্কারক নন, তিনি এক নতুন মতবাদের প্রবক্তা। 

  বাবাজী মহারাজ তার নিম্বার্ক দর্শনে শিক্ষাপ্রবন্ধে লিখছেন – “ ভগবানকে বাদ দিয়ে কেবল ইন্দ্রিয়ভোগের মাধ্যমে শান্তি পাওয়া যায় না। জগতকে তাচ্ছিল্য করায় আমরা নিঃস্ব হয়েছিলাম। এখন ধর্মকে বাদ দিয়ে আমরা উচ্ছৃঙ্খল হলাম। ব্রম্ভ মিথ্যা, জগত সত্য ভাবলে অর্থাৎ ভগবান নাই, জগৎটাই সব এই ভাবনা দীর্ঘদিন ভারতের মাটিতে কাজ করেছে। 

শ্রীনিম্বার্কাচার্য্য শঙ্করাচার্য্যের বহু আগেই বলে গেছেন ব্রম্ভ সত্য, জগৎও সত্য। জগতকেও বাদ দেওয়া যাবে না, আবার ভগবানকেও বাদ দেওয়া যাবে না। পরাবিদ্যার জন্য অপরাবিদ্যার দরকার, কিন্তু মনে রাখতে হবে শ্রীভগবানকে লাভ করার জন্য জাগতিক বিদ্যার দরকার। 

বাবাজী মহারাজ  লিখছেন, “আজ হয়েছে উলটো। বৈষয়িক উন্নতির জন্যই আজ আমরা ভগবানকে ডাকি। আসলে জীবনের মূল লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। সেই ঈশ্বরকে পেতে হলে আহার, বস্ত্র এবং বাসস্থানের দরকার।

 বাবাজী বলছেন – “সাম্যের জাগরণ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থা ও জীবনচর্যার মধ্যে। পরিশীলিত শৃংখলতা মানুষকে আত্মবোধে বা সাম্যবোধে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাই সাম্যবাদ কোন মুখস্থ বুলি ছিল না, ছিল অন্তরের আন্তরিকতা। 

তিনি বলতেন, ‘সাম্যের জাগরণ না ঘটলে সবই নিছক কথাতে পরিণত হয়। কেন এ কথা তিনি বলেছেন? আমরা ফিরে যাই সূদূর অতীতে। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় বলা হয়েছে  

যাবত ভ্রিয়েত জঠরম তাবত স্বত্বং হি দেহিন 

অধিকং যোহভিমন্যেত স স্তেনো দণ্ডমর্হতি।।“ (৭/১৪/৮) 

এর বাংলা অর্থ হল যতটুকুতে একজনের গ্রাসাছাদন চলে, সমাজ থেকে সেটুকুতেই তার অধিকার, যদি সে অতিরিক্ত সে নেয়, তাকে শাস্তি পেতে হয়। বাবাজী বলছেন পুঁজিবাদকে এ ভাবেই প্রাচীনকালে নস্যাত করা হয়েছে। আর তার বাস্ত রূপায়নের জন্য অনুশাসনও ছিল। 

বাবাজী রন্তিদেবের উপাখ্যান তুলে বলেছেন – “রাজা বলেছেন –‘আমি ব্যক্তি সুখ চাই না, মুক্তি চাই না, সমস্ত দুঃখী মানুষের দুঃখ আমার কাছে আসুক, তারা সুখী হোক, এটাই আমি চাই।‘ – সাম্যবোধের কী অপরূপ সমাপ্তি।

 


তিনি বলেছেন –‘সমশব্দটির সাধারণ অর্থ সমান ভাব। শ্রীগীতায় বলা হয়েছে  

বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাম্ভণে গবি হস্তিনি। 

শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।।

 এর বাংলা অর্থ হল জ্ঞানী মানুষরা - বিদ্যা ও বিনয়ী ব্রাম্ভণ, গোরু, হাতি, কুকুর এবং চণ্ডালকে সমান দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। 

বৈদেশিক সাম্যবাদের শুধু মানুষ নিয়ে চিন্তাভাবনার চেয়ে তাই গীতা অনেক এগিয়ে। বাবাজী বলতেন, ‘সাম্য নিজেই সাধনা, নিজেই সিদ্ধি।ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে ধর্মের সার হল, যা নিজের কাছে খারাপ, দুঃখকর বা প্রতিকূল, সেই আচরণ অন্যের সঙ্গে করবে না।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad