তারক ঘোষ
উপরের কথাগুলি শ্রীশ্রী জানকীদাসজী মহারাজের। বাবাজী
মহারাজ প্রায়ই ওই কথাগুলি বলে আমাদের শিক্ষা
দেওয়ার চেষ্টা করতেন, যাতে আমরা আমাদের প্রতিটি কাজকে সুষ্ঠুভাবে করতে পারি। অনেকে মনে করেন সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাই
বৈরাগ্য। আমার সংসারে আর মন বসছে না, তার মানে বৈরাগ্য এসে গেছে, এবার ঈশ্বরের
আরাধনা করা যেতে পারে। বাবাজীর কথায় এটা মস্ত ভুল। এটা পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
যারা এভাবে পালানোর রাস্তা খোঁজে, তারা কোন কিছুই করতে পারে না। না, ভালোভাবে
সংসার করতে পারে, না, ভালোভাবে ভগবানকে ডাকতে পারে।
প্রতিটি কাজকে যিনি মনে করবেন ভগবানের কাজ, প্রতিটি
কাজ যিনি ভগবানের সেবা জ্ঞানে করতে পারবেন, তিনি ততই সকলের কাছে প্রিয় হবেন। তার
কাজে ভুল যেমন হবে না, তেমনই সুন্দর হবে, গোছানো হবে তার প্রতিটি কাজ। আর এটাই হলো
সংসার আর ভগবান সাধনার প্রথম শর্ত।
দাদাজীর কথা ষ্মরণ করিয়ে দিয়ে বাবাজী মহারাজ বলতেন,
কর্মে মনযোগী না হতে পারলে, সে ধ্যান করা তো দূরের কথা, জপটাও ঠিকঠাক করতে পারবে
না। কারণ, মনোযোগ আর ভালোবাসা – এই দুটি বিষয় মানুষকে যে কোন কর্মে সফল করে। আর
এটা একটা অভ্যাস। একদিনে এটা হয় না। এর জন্যও সাধনা প্রয়োজন।
অনেকের সংসারে দেখবেন, সবকিছুই আগোছালো। কেমন যেন
বিশৃঙ্খলার ভাব। রান্নাঘর, শোবার ঘর, স্নানের ঘর এমনকি ঠাকুরঘরেও সেই আগোছালো
চেহারা। এটা বাড়ির কর্তা বা কর্ত্রীর আসল চেহারাটাকে প্রকাশ করে। এটা সুস্থ সংসার
জীবন নয়। দাদাজী মহারাজ বলতেন – যে কাজ করবে, মন ঢেলে করবে, এতে ভগবান প্রসন্ন হন।
সংসার জীবনে যে সফল, সে সাধন জীবনেও সফল হতে পারে।
সংসারে যিনি সব কাজ সুচারুভাবে শেষ করতে পারেন, অথচ কামনাশূন্য ভাবে, তিনিই যোগী।
তিনি বিদেশী কালচারে সেজেগুজেও হতে পারেন ভগবানের কাছের জন। ভগবান, যে বৈরাগ্যকে
পছন্দ করেন, সেটি বাইরের বৈরাগ্য নয়, অন্তরের বৈরাগ্য।
আর এই অন্তরে বৈরাগ্য নিজে নিজে তৈরি করা যায় না, এটা
আসে। আসে উপলব্ধি থেকে। কোনটা স্থায়ী আর কোনটা স্থায়ী নয়, এটা মানুষ যখন অন্তর
দিয়ে উপলব্ধি করে, তখনই জন্ম হয় বৈরাগ্যের। আর এই বৈরাগ্য উদাসীনতার বৈরাগ্য নয়,
এই বৈরাগ্য চিরসত্য- চিরসুন্দর-চিরস্থায়ীকে পাওয়ার টান।
বাবাজী মহারাজ বলতেন – যিনি সংসারের বেশি নিন্দা
করেন, বউমা-ছেলের নানা কথা তুলে, তাদের সমালোচনা করেন, জানবেন, তিনি সবচেয়ে বেশি
ভালোবাসেন তার সংসারকে, তার ছেলে-বউমাকে।
কারণ, তিনি তখনো ঈশ্বরের নাম-গান করলেও, আশ্রমে এসে সাধুবাবাদের
কথা শুনে অশ্রু বিসর্জন করলেও আসল জায়গা থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছেন। সেটা হলো
প্রকৃত উদাসীনতা কারো দোষ দর্শন করে না। অন্যের সমালোচনা করে, নিজেকে মহান ভাবার
কোন কারণ নেই, কারণ ওই দোষগুলো আপনাকেও সেই মুহুর্তে প্রভাবিত করবে। আপনিও একসময়
সমালোচিত হবেন। এর মানে, এই নয়, একজন অপরাধীকে আপনি অপরাধী বলবেন না।
অন্যের দোষ দর্শন মানে হলো, কোন কারণ ছাড়াই অন্যের
নানা কাজের সমালোনা করে, নিজেকে মহান দেখানোর প্রচেষ্টা।
যতদিন যাচ্ছে, আমরা বহির্মুখী হয়ে পড়ছি। যেদিন আমরা নিজেদের মনের মধ্যে
ঢুকতে পারবো, সেদিন আর আমাদের কোন কষ্ট থাকবে না। বাইরে যা কিছু আমরা দেখি,
পরোক্ষে সেগুলি কোন না কোনভাবে আমাদের মনে প্রভাব খাটাতে থাকে। অন্যের
বাড়ি-গাড়ি-বিদেশ ভ্রমন- সব কিছুই আমাদের মনে যখন ছায়াপাত করতে থাকে, তখন থেকেই
নিজের অজান্তেই অশান্তি শুরু হয়।
এই বাইরের মনকে ভিতরে এনে বন্দী করাটাই সবচেয়ে কঠিন কর্ম। দেখবেন, বড় বড়
বিজ্ঞানী, সাধক, লেখকরা বাইরের জগতের ঘটনাবলী নিয়ে নিজেদের মনকে তোলপাড় করে ফেলে
না। তারা সব খবর রেখেও, তাদের যে কাজ সেটাই করতে থাকেন। গৃহীরাও, এটা করতে পারলে,
তাদের মানসিক শান্তির অভাব ঘটবে না।
বাবাজী মহারাজ তার শ্রীগুরু কথা তুলে বলতেন –ইন্দ্রিয়ের এই বহির্মুখীনতা
যেন বুনো ওল, সব সময় কূট কূ্ট করে অন্তরকে বিচলিত করে।
বাবাজী বলেছেন- বুদ্ধির দ্বারা মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। জ্ঞানের সাহায্যে মন
যখন বোঝে বিষয় ভোগে শান্তি নেই, শান্তি
আছে আত্মদর্শনে,
তখন ইন্দ্রিয়ভোগ এর
ব্যাপারে মন সংযত হয়।“
তার কথায়, প্রথমেই মনের চঞ্চলতা ত্যাগ করতে হয়, কারণ এই চাঞ্চল্য মানুষকে এক অবস্থা থেকে
অন্য অবস্থায় তাড়িয়ে নিয়ে যায় আর মানুষও ক্রমশঃ আরো—আরো চাইতে থাকে।
সংসার জীবনে নির্বিকার থাকার সাধনা করলে মানুষ ভালো থাকতে পারে। এই
নির্বিকার থাকা আর বৈরাগ্য এক নয়। নির্বিকার থাকা মানে, সবকিছুতেই নাক গলানোর
অভ্যাস বর্জন করা, যেখানে সেখানে অযাচিতভাবে নিজের জ্ঞান জাহির না করা, অন্যের
সঙ্গে নিজের পরিবারে সদস্যদের তুলনা না করা – এরকম নানা বিষয়।
বাইরে হতে হয়, পাকা বিষয়ী আর অন্তরে বিষয়াসক্তিহীন। এটাই সাধনা। যিনি এই
সাধনায় সফল, তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী। সংসারে থাকলেও।