ধর্মের সঠিক রূপ কী? সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি ও বাবাজী মহারাজ



ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষত হলো সাম্প্রদায়ীকতা। প্রাক স্বাধীনতা সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পায়নি ভারত। আর এই শত্রুতার জন্ম দিয়েছিল ব্রিটিশ-রাজ, তাদের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির মধ্য দিয়ে। এই সাম্প্রদায়ীকতার পরিণামে বারবার রক্ত ঝড়েছে  মানুষের মানবিকতার - যে রক্তের রঙ কিন্তু লাল।

তারক ঘোষ

জাতের নামে মানুষের মধ্যে এই ভেদাভেদ বাবাজী মহারাজকে বারবার ব্যথিত করেছে। হিন্দু ও মুসলমানের পাশাপাশি বাস করা, একে অন্যের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়ার মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক মিলনের ছবি – সেটাকে তিনি কখনো ভাংতে চান নি। তাই, সাংবাদিকদের কাছে তিনি উচ্চ কন্ঠেই বলেছিলেন – আমি এসেছি ধর্মের নামে হানাহানি বন্ধ করতে। কতটা পেরেছি, বা পারবো কিনা  জানিনা।

 


আগামি ২৩ অগাস্টের মধ্যে এই বইটির জন্য আপনার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর সহ জানান এই whatsapp নম্বরে: 8927042594


বাবাজী মহারাজের কাছে প্রথম ও প্রধান জাত ছিল মানুষ। সব মানুষের একটাই পরিচয় তারা মানুষ। আর এই মানুষ খুঁজতে গিয়ে তিনি কখনো জাতের বিচার করেন নি। হিন্দু, মুসলমান, পার্সী কিংবা খ্রীষ্টান এ দিয়ে তিনি মানুষকে বিচার করতেন না। জন্মসূত্রে কে ব্রাম্ভন, কে মুসলমান এভাবে জাতকে তিনি দেখেন নি। আর দেখেন নি বলেই গীতা, বাইবেল, কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তার কন্ঠে উচ্চারিত হতো। সকল ধর্মের সব ধর্মগুরুদের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। 

 

তিনি উঠতে পেরেছিলেন, জাত-পাত, ধর্মীয় কুসংষ্কারের অনেক উর্ধে। কিন্তু, কেন তার এই সমাজ ভাবনা? এই সমাজ ভাবনা, জাত-পাতের কুসংষ্কার সম্পর্কে শিক্ষার একটা অংশ তিনি পেয়েছিলেন তার স্কুলের মাষ্টারমশাই মোজ্জামেল হক সাহেবের কাছ থেকে। 




মোজাম্মেল সাহেব স্কুলের লাইব্রেরী থেকে রামায়ণ-মহাভারত এনে বাবাজীকে বলতেন তুই ব্রাম্ভণের ছেলে, এগুলো পড়। তিনি বাবাজীকে বই-খাতা-পেন কিনে দিতেন। একবার বাবাজীর বৃত্তি পরীক্ষার সময় মোজাম্মেল সাহেব ডাব হাতে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন বাবাজীকে ডাব খাওয়াবেন বলে। বাবাজী পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে প্রশ্নপত্র দেখাতে গেলে মোজ্জামেল সাহেব বলেন ওটা পরে দেখবো, আগে ডাব খা। 

এটাই তো মানবিকতা, মানুষ যে জন্য। কোথায় জাত! কে ব্রাম্ভণ, কে মুসলমান!

এছাড়া, তিনি বেশ কয়েকজন মানুষের কথা কখনো ভোলেন নি। এদের মধ্যে ছিলেন এক মুসলমান মহিলা। যিনি বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘বাপজান, এখন খেয়ে নে, পরে বড় হয়ে জাত-পাত মানিস।‘ 

এই শিক্ষা তিনি রেখে দিয়েছিলেন তার চেতনার গভীরে। তিনি ভোলেননি তার স্কুল শিক্ষক সিদ্ধেশ্বরবাবুর কথা, যিনি বাবাজী মহারাজকে বলেছিলেন- তোর যা জামা-কাপড় লাগে, আমি দেব।তার মনে ছিল, প্রীতিদির কথা, যিনি নিজের ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে বাবাজীকে কোলে তুলে নিতেন। 

কীভাবে বাবাজী সমাজের এই মানুষগুলোর কথা ভুলতে পারেন! মোজ্জামেল হক, কিংবা ওই মুসলিম মহিলা তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন, আসল সত্য হল মানবতা। জাত বাহ্যিক একটা পোশাক।

 কালো আর

ধলো, বাহিরে কেবল,

ভিতরে সবারই সমান রাঙা।

 একদিন আশ্রমে বাবাজী মহারাজের ওখানে বসে তার পাঠ শুনছি। এক মুসলমান ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন বাবাজীর দুয়ারের পাশে। তখন নতুন মন্দির হয়নি। পুরানো জায়গাতেই বাবা বসতেন। ভক্তনিবাস তৈরির আগের কথা বলছি।



 বাবাজী পাঠ থামিয়ে ওনার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন দাঁড়িয়ে কেন, এখানে এসে দুয়ারে বসুন। উনি ইতস্ততঃ করছেন দেখে বাবা রাধামাধবকে ডেকে বললেন ওনাকে ঠাকুরজীর প্রসাদ দিতে। রাধামাধব ঠাকুরজীর প্রসাদ এনে ওই মুসলমান ভদ্রলোকের হাতে দিলেন।

 উনি ভক্তিভাবেই সেই প্রসাদ গ্রহণ করলেন। বাবাজী এরপর বললেন, পাঠ হচ্ছে। আপনি ইচ্ছা হলে শুনতে পারেন। ওই ভদ্রলোক কীজন্য এসেছিলেন জানি না। তবে তিনি সেদিন বসে বাবাজীর পাঠ শুনেছিলেন।

পরে জেনেছি, মুসলমান পাড়ার বহু মানুষ বাবাজী মহারাজকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন। আসলে এটাই তো ধর্ম। ধর্ম আমাদের হৃদয়টাকে অনেক বড় করে দেয়। সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে শেখায় আর শেখায় সব ধর্মকে সমান চোখে দেখতে। 

কারণ, তিনি আমাদের ভাগ করে পাঠাননি। আমরাই ভাগ করেছি। কেউ তাকে আল্লা বলেন, কেউ গড, কেউ বা ভগবান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন ছাদে ওঠার জন্য কেউ মই ব্যবহার করতে পারে, কেউ বা সিঁড়ি। জলকে কেউ বলে ওয়াটার, কেউ পানি, কেউ জল। তাতে কী জলের ধর্ম বদলে যায়? বাবাজী এভাবেই দেখেছিলেন সবকিছু। 




তাই করিমগঞ্জে মহানাম্ব্রত ব্রম্ভচারীকে নিয়ে আয়োজিত জন্মশতবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন আমি কী করে বলব মুসলমান মাত্রই খারাপ। আমি তাই বলব মহানাম ব্রম্ভচারীজীর কথা মানুষ মানুষই। কোন জাতের দ্বারা আমরা আবদ্ধ যেন না হই। যদি মহানামজীকে ভালোবাসতে চাই, এরকমই আমাদের চিন্তা করতে হবে। 

ধর্মের নামে আমরা বজ্জাতি করছি, তাই ধর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ছে কুসংষ্কার। বুঝে দেখুন, এই জ্ঞানতপস্বী কী ছিলেন! সব মানুষকে একই ছাতার নীচে শুধু এক মানুষ হিসাবেই দেখতেন। 

আজ যখন আমরা টিভির খবরে রিষড়া, ডালখোলা, হাওড়ার ঘটনা দেখি, বাবাজীর কথা বড় মনে হয়। বাবাজী মহারাজ তাই সেদিন বলেছিলেন ফুল হয়ে ফুটছেন তিনি, ফল হয়ে ঝড়ছেন তিনি, ছেলে হয়ে মায়ের দুধ খাচ্ছেন তিনি। সেই তিনি একই অঙ্গে বহুরূপ। আল্লা, গড, ভগবান। মহানামব্রত কোন নাম নয় একটা মঞ্চ। এই মঞ্চের নাম মহানাম মঞ্চ। মহানামকে একটা সম্প্রদায় বানাতে চাইলে আমার আপত্তি আছে। এখানে সবাই সমান।

 এবার আসি সেই ঘটনায়, যে ঘটনায় বাবাজীকে এক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন -শুধু আপনার জন্যই আজ দাঙ্গার হাত থেকে আমরা বেঁচে গেলাম।ঘটনাটির সূত্রের জন্য আমি স্বামী সদগুরুদাসজীর কাছে কৃতজ্ঞ।

২০০০ সালের ঘটনা এটি। বাবাজী তখন অসমে। আগস্ট মাসে গিয়েছিলেন নিখিল ভারত বঙ্গ সম্মেলনেযোগ দিতে তিনসুকিয়ায়। সেখানে এক সভায় তিনি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন। সেদিনের বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেছিলেন প্রাচীন যুগের মানবীয় মূল্যবোধের অবলুপ্তির কারণ। তিনি তার দেড় ঘন্টার ভাষণে খুব সুন্দর-সহজ-সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে এই মানবীয় মূল্যবোধের অবলুপ্তি ঘটছে বা ঘটছে। 




সেই বছরের সেপ্টেম্বর মাস। তারিখটা ছিল ২৩। অসমের হাইলাকান্দি শহরে আদি কালীবাড়ি মন্দিরে গীতারথ উদ্বোধনের জন্য তাকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বাবাজী মহারাজ এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু, যে কোন কারণে শহরে একটা সাম্প্রদায়ীক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। 

আর এব্যাপারে প্রশাসনের মধ্যেও একটা আশংকা ছিল। তবু, এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তারা বাধা দেয় নি। ওই অনুষ্ঠানে সেদিন আমন্ত্রিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শহীদুল আলম চৌধুরী। তিনি ছিলেন অসম গণ পরিষদের বিধায়ক ও মন্ত্রী। 

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি পৌর প্রশাসন বিভাগ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল মন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৯৬ সালে অগপ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী হন। সহিদুল আলম চৌধুরী হাইলাকান্দি জেলার আলগাপুর কেন্দ্র থেকে পাঁচবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং অসম সরকারের দু'বার ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১০ সালে তার মৃত্যু হয়।

যাইহোক, সেদিন তিনিও উপস্থিত ছিলেন বাবাজী মহারাজের সঙ্গে। স্বভাবতইঃ প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে একটা স্বাভাবিক টেনসন কাজ করছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের মধ্যেই একটা চাপা আতঙ্ক। একদিকে সংঘর্ষের আশঙ্কা, অন্যদিকে, এই অনুষ্ঠান আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। বাতিলও করা যায় না। মন্ত্রী নিজে উপস্থিত। 

পুলিশ পড়েছে মহা চিন্তায়। যে কোন সময় আক্রমণ হতে পারে। আর তা যদি হয়, তাহলে পুলিশের কাছে তা হয়ে উঠবে চ্যালেঞ্জের। অন্যদিকে, রাজ্যের মন্ত্রী উপস্থিত। আশেপাশে অন্য গোষ্ঠীর মানুষজনের ভিড় বাড়ছে। বাবাজী মহারাজ তো হিন্দু ধর্ম বিষয়ক বক্তব্য রাখবেন। তাকেও নিষেধ করা যাচ্ছে না। 

ঠিক এই রকম টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতে বাবাজী মহারাজ উঠলেন তার বক্তব্য রাখতে। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছেন বাবাজী মহারাজ কী বলেন। পুলিশের বড় বড় অফিসার ও পুলিশ বাহিনী লাঠিবন্দুক নিয়ে তৈরি। যদি দাঙ্গা বাঁধে সামাল যেমন দিতে হবে, তেমনই মন্ত্রী ও বাবাজী মহারাজকে নিরাপদে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে।

এইরকম অবস্থায় বাবাজী বলে উঠলেন পৃথিবীতে দুটি জাতি আছে।বাবাজীর কথা শুনেই উত্তেজনা আরো বেড়ে উঠলো। সবাই ভাবছেন, এইবার দাঙ্গা লাগল বুঝি। 

বাবাজী মহারাজ তার শান্ত-সমাহিত স্বরে বলতে শুরু করলেন- পৃথিবীতে দুটি জাতি আছে। সেই দুটো জাতি হলো সুআর কু। এতক্ষণ যে শ্বাসটা বুকে আটকে ছিল, সকলে তা বাতাসে ছাড়লো।

 বাবাজী শান্তভাবে বলে চলেছেন একদল আছেন, যারা পৃথিবীকে সুন্দর করতে চান। আর এক দল আছেন, যারা এই সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চান। 

আমাদের মনে রাখতে হবে কৌরব পান্ডবের যুদ্ধ হিন্দুদের মধ্যেই হয়েছিল। সিয়া-সুন্নীর লড়াই মুসলমানের মধ্যেই হয়েছিল। ক্যাথলিক প্রোট্যাস্ট্যান্টদের লড়াই খ্রীষ্টানদের মধ্যেই হয়েছিল। অর্থাৎ, এই সু আর কু এর লড়াই আমাদের মধ্যে সর্বদাই চলছে। 

হিন্দু, মুসলমানের শত্রু নন, মুসলমানও হিন্দুর শত্রু নন। 

গীতারথ সেদিন নির্বিঘ্নে উদ্বোধন হয়ে গেল। চারিদিকে তখন গুনগুন কে এই সাধু?? বাবাজী মহারাজ ভিড় এড়িয়ে গাড়ি করে ফিরে গেলেন। পরে পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার বাবাজী মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

 তিনি বাবাজীকে প্রণাম করে বলেন যে কোন মুহুর্তে সেদিন দাঙ্গা লাগতে পারতো। শুধু আপনার জন্যই আমরা আর এ আমাদের ই শহর সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। আপনার জন্যই আমরা বেঁচে গেলাম।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad