তারক ঘোষ
শ্রীশ্রী সন্তদাসবাবাজী মহারাজ লিখেছেন –‘সাধু কেবল নিজে নির্দোষ থাকলেই চলবে না। বাইরের লোকও যাতে দোষ আশঙ্কা করতে না পারে, এরূপ আচরণ করা ঠিক নয়। বাইরের ঠাট হয়তো বজায় থাকবে, কিন্তু, ভিতর শূন্য হয়ে যাবে।“
ড প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া ছিলেন একজন জ্ঞানতপস্বী সাধক। তার শিক্ষার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। আর
তিনি তার সেই লক্ষ্যের কথা নানাভাবে নানা জায়গায় বলেছেন।
শিক্ষা ও অর্জিত জ্ঞানকে যেমন ব্যক্তিগত উন্নতির কাজে লাগানো যায়, ঠিক তেমনই সমাজ তথা দশের ও দেশের উন্নতির
কাজেও ব্যয় করা যায়। উদাহরণ
হিসাবে বলা যেতে পারে, কেউ চিকিৎসক
হয়ে, তার অর্জিত
জ্ঞানকে পুরোপুরিভাবে নিজের আর্থিক উন্নতির পিছনে ব্যয় করেন। কেউ বা, চিকিৎসা বিজ্ঞানী হয়ে তার অর্জিত জ্ঞানকে গবেষণার কাজে নিয়োজিত করেন। তার গবেষণার সাফল্য
ভোগ করে সমগ্র মানব সমাজ। বাবাজী মহারাজ এ কথাই তাই বলতেন – সাধুরা তো সংসারত্যাগী। তাদের সংসারী মানুষের মতো নানা কাজে লিপ্ত থাকতে হয়
না। এই সাধু সমাজ যদি সমাজের মঙ্গল চিন্তায় তাদের জ্ঞানকে ব্যয় করেন, তাহলে সমাজের
মানুষ নানাভাবে উপকৃত হতে পারেন।
জ্ঞান এমন একট শক্তি যা অজ্ঞানতা ও কুসংষ্কারকে দূর করে। সমাজের অন্ধকার দিককে আলোকিত করার জন্য প্রয়োজন হয় জ্ঞানের আলো। আর এই জ্ঞানের আলোর সন্ধানেই থাকেন সাধকরা। সংসার ত্যাগ করে বেছে নেন এমন এক জীবন, যে জীবন ঈশ্বর ও জগতের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা যেতে পারে। এই পৃথিবীতে আসা তখনই সার্থক হয়, যখন কোন ব্যক্তি নিজ স্বার্থের উর্ধে থেকে মানব-কল্যাণে নিজের জীবন ব্যয় করেন। তিনি সাধু হতে পারেন, বিজ্ঞানী হতে পারেন, লেখক, শিল্পী- যে কেউ। এই জীবনের কথাই ড প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ বলতেন। তিনি একটি কবিতার উধৃতি দিয়ে বলতেন – ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন-মন সকলই দাও…/ তার কথায় বিশ্বাস, ভক্তি বা প্রেম আর জগত-কল্যাণ
– এই তিন নিয়েই ধর্ম।
তিনি বলেছেন - রামায়ণ, মহাভারতকে শুধুমাত্র
ধর্মের গন্ডীতে বেঁধে রাখলে আমাদের তথা এই হিন্দু জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। কারণ, এই দুই মহাকাব্য অসাধারণ দুই সমাজ-দর্শন। মানুষের সম্পর্ক, সম্পর্কের ভাঙ্গন, বন্ধন ও বন্ধন ছেঁড়ার
কাব্য-কাহিনী। এখানে সমাজ যেমন আছে, তেমনি আছে রাষ্ট্র। একটা রাষ্ট্রের ভূমিকা কী, সুস্থ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা
এবং তার সঠিক পরিচালনা কীভাবে একটা জাতিকে সমৃদ্ধির পথ দেখাতে পারে, তারও ইঙ্গিত আছে।
এই দুই মহাকাব্যে, আমরা দেখতে পাই
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভাঙ্গন। দেখতে পাই বিশ্বাস ও বিশ্বাস-হীনতা।
দেখতে পাই লোভ-লালসা ও কামনার বিকৃত রূপ ও তার পরিণাম। এক অসাধারণ সমাজতত্ব এই দুই
মহাগ্রন্থ। যেখানে ধর্মের আলোকে জাতিকে সঠিক পথ দেখানো হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, ছোটদের এই দুই মহাকাব্য
পাঠ থেকে একেবারেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। আজকে যদি, কোন তরুণ-তরুণীকে বলা হয়, তারা রামায়ণ, মহাভারত পড়েছে কি না, তারা অদ্ভুতভাবে আমার
দিকে তাকাবে। যেন আমি কোন মধ্যযুগের মানুষ আজও মধ্যযুগীয় মানসিকতা নিয়ে বেঁচে আছি।
কেউ বলবেন – ‘ওই পড়েছি’, কেউ বলবেন, ‘টিভিতে সিরিয়ালে দেখেছি।‘
অনেকে ভাবেন, এই দুই গ্রন্থ পাঠ করলে, আধুনিক হওয়া যায় না। আমি
জোরের সঙ্গে আপনাদের বলি, এই দুই মহাকাব্য আর শ্রীগীতা জাতির মেরুদন্ড। ভালো আর
মন্দের পার্থক্য দেখিয়ে এক নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক এই দুই মহাকাব্য, শ্রীগীতার মধ্যে
ব্যাখ্যাত হয়েছে মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার মূলমন্ত্র।
গীতার
বাণী তাই শুধু পাঠ করার জন্য নয়, জীবনে তার প্রতিফলন প্রয়োজন।
বাবাজী মহারাজ তাই বারবার বলেছেন, এই সমাজে সাধুদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধকরা
বারবার ঈশ্বলাভের কথা বলেন, শান্তি লাভের কথা বলেন। কিন্তু, প্রকৃত সুখ বা শান্তিলাভ বলতে ঠিক কী
বোঝায়, কীভাবে তা পাওয়া সম্ভব, সেই জায়গাটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। এর ফলে,
বহু মানুষই ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না ঈশ্বরের পথ বলতে কী
বোঝানো হয়েছে।
বাবাজী বলেছেন, আমি যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করি, প্রকৃত সুখ বলতে কী, জড়বাদ বা আধুনিক ভোগ-ব্যবস্থা? লিভ-ইন, ফ্রি-সেক্স ইত্যাদি? কেউ আমাকে বলবেন, এটা একটা বুর্জোয়া প্রশ্ন, কেউ বা
বা বলবেন দার্শনিক প্রশ্ন। কিন্তু,
এই প্রশ্ন সাধুসমাজকেই করতে হবে আর উত্তর দিতে হবে তাদেরই। কারণ, ধর্ম যদি ভোগবাদী হয়ে পড়ে, উশৃঙ্খল হয়ে পড়ে, তার একটা দায় সাধুদের উপরেও বর্তায় বলে মনে করতেন বাবাজী মহারাজ। এই প্রসঙ্গে তিনি কুম্ভ-মেলার প্রসঙ্গ
টেনে বলেছেন – সেখানেও ধর্মের নানা বিকৃত রূপ তিনি দেখেছেন।
প্রকৃত বৈষ্ণবের কোন জাত নেই, শত্রু নেই, তিনি মানবতার পূজারী। এই অর্থে প্রত্যেক সৎ ব্যক্তিই বৈষ্ণব। ভগবানের ভক্ত বা সত্য শিব সুন্দরের পূজারী ব্রাম্ভন নন, ক্ষত্রিয় নন, শূদ্র নন, খ্রীষ্টান নন – তিনি ভক্ত। পৃথিবীটাকে সুন্দর করার জন্যই তারা জীবন ধারণ করেন।
বইটি কিনতে উপরের ছবিটিতে ক্লিক করুন। সরাসরি প্রকাশকের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন
প্রকৃত শান্তি পেতে হলে কী করতে হবে? এই প্রসঙ্গে বাবাজী মহারাজ তার শ্রীগুরু জানকীদাসজীর কথা টেনে বলেছেন, আত্মাকে জানাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তির পথ। ঈশ্বরের অধিষ্ঠান মানুষের ভিতরেই, প্রথমে তাকেই জানতে হবে। আর এটাকি লক্ষ্য হিসাবে মেনে নিয়ে ওদিকেই এগোতে হবে। আর এক্ষেত্রে, আলাদা আলাদা ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। সব ভেদ মিলে যাবে একের মধ্যে। সেই এক সেটা ঈশ্বর, গড, আল্লা – যা কিছুই হতে পারে।
আর একটি কথা তিনি বলেছেন, তা হলো ত্যাগ। সন্ন্যাসীরা সংসার ত্যাগ
করেন, দুঃখের কারণ থেকে মুক্তি
খুঁজে ঈশ্বরের সাধনা করার জন্য। সকল মানুষের মঙ্গল সাধনায় তারা তাদের জীবন ও মন
উৎসর্গ করেন। ভোগবিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা মন সমর্পন করেন ঈশ্বরের পদতলে। অর্থের
দিকে ফিরেও তাকান না। মনের মধ্যে তাদের থাকে না কোন লোভ, হিংসা, কামনা বা বিত্ত-বাসনা।
সবকিছু পার্থিব লোভের বিষয় ত্যাগ করে তারা হয়ে ওঠেন সর্বত্যাগী। ত্যাগই তাদের ব্রত, ত্যাগই তাদের মুক্তি।
শ্রীশ্রী সন্তদাসবাবাজী মহারাজ লিখেছেন –‘সাধু কেবল নিজে নির্দোষ
থাকলেই চলবে না। বাইরের লোকও যাতে দোষ আশঙ্কা করতে না পারে, এরূপ আচরণ করা ঠিক নয়।
বাইরের ঠাট হয়তো বজায় থাকবে, কিন্তু, ভিতর শূন্য হয়ে যাবে।“
কাজেই, গৃহী মানুষের কাছে ‘ত্যাগ’ হলো ভালো থাকার পাসওয়ার্ড
আর সন্ন্যাসীদের কাছে ব্রত। যিনি এই ব্রত সঠিকভাবেই তার জীবন ও দর্শন দিয়ে পালন
করতে পারেন, তিনিই যথার্থ সর্বত্যাগী।
নিম্বার্ক দর্শন, অন্যের ধর্মকে
শুধু সহ্যই করে না, সত্য বলে স্বীকারও করে। তার কথায়, সমাজ থেকে কুসংষ্কার দূর করার কাজটা প্রথমে করতে হবে সাধু সমাজকেই। কারণ,
তার মতে সমাজে অনন্তকাল ধরে ধর্মের নামে কিছু কুসংষ্কার স্থায়ী বাসা বেঁধে রয়েছে। এগুলোকে
সমূলে তুলে ফেলতে পারেন একমাত্র সাধু-সমাজ। তারা যদি মানুষকে বলেন, এগুলো এই
আধুনিক সময়ে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা বিজ্ঞান এটাকে স্বীকার করে না।
উপনিষদে আছে- “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।“ আমি দুর্বল, আমি পারি না, এটা কোন কাজের কথা নয়। বিজ্ঞানের
দ্বারাই ঠিক করে নিতে হবে নিজের কর্তব্য কী। আর এই বিজ্ঞান হলো ভগবান তথা সত্যকে পাওয়ার একটা শানিত অস্ত্র।
এই প্রসঙ্গে তিনি মানুষের উপর ‘দেবতার ভর’
বিষয়টি নিয়ে বলেছিলেন - “মানুষের উপর দেবতার ভর
হওয়া, এই ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস
করিনা। এগুলোর পিছনে উদ্দেশ্য থাকে, অনেক সময়, মৃগি রোগের শিকার হওয়া কোন রমনীকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ভর হয়েছে
বলে প্রচার করে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে
কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু কাজ করা হয়।“
সময়
বদলেছে, সাধু সমাজের মধ্যেও
বিজ্ঞান-মনস্ক ভাব রাখতে হবে। যে
অনাচার যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে, তার শেষ হওয়া প্রয়োজন বলে যেমন তিনি মনে করতেন, পাশাপাশি মনে করতেন জাত-পাতের লড়াই বন্ধ করতে হলে
ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।
বাবাজী মহারাজ পাঠচক্রে বসে, প্রায়ই এই ‘জাত প্রসঙ্গ’ তুলে, তার ব্যাখ্যা দিতেন। তিনি
বিশ্বাস করতেন, জাতের শ্রেণিবিভাগ হওয়া
উচিত বৈজ্ঞানীক দৃষ্টিভঙ্গীতে। কিন্তু জানকীদাসজী মহারাজ সেই প্রথা ভেঙ্গে সমাজে
বিশৃঙ্খলা আনার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি বুঝেছিলেন, গুণ ও কর্ম অনুসারে কে
ব্রাম্ভণ, কে ক্ষত্রিয় তা নির্ণয়
করতে গেলে বেশি ক্ষেত্রেই বিবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। কে এই বিচার করবে, তা নিয়েও দেখা দেবে
মতভেদ।
বাবাজী তাই বলতেন, “শ্রীবাবাজী মহারাজ
(জানকীদাসজী মহারাজ) নতুন পদ্ধতি প্রচলিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানের পদ্ধতিকেই
মেনে নিয়েছিলেন।“
এর একটা বৈজ্ঞানিক কারণ হিসাবে বাবাজী বলতেন – সৎ পিতামাতার সৎ সন্তান
জন্ম নেয়। বিজ্ঞান এই তত্বকে জিন তত্ববলে। ভালো জিনের অধিকারী ভালো জিনের সন্তান
জন্ম দেবে। বাবাজী একজায়গায় লিখছেন – “সাধু সমাজের মধ্যে এই আশা করেই পিতা-মাতার বংশ নিয়েই
সূতাধারী (পৈতাধারী), মালাধারী (কণ্ঠীধারী) সাধুদের মধ্যে ভেদ করা হয়।
দেখা যায়, অনেক সময় নিম্ন অধিকারী ব্যক্তির মধ্যেও সাময়িক সত্ব গুণের
প্রাবল্য দেখা গেলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আগের খারাপ সংস্কার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
এরকম ব্যক্তির সাময়িক ভাবকে লক্ষ্য করে যদি তাকে আশ্রমের উচ্চ পদে অভিষিক্ত করা
হলে, তার ভিতরের খারাপ
সংস্কারের জন্য মানুষের যথার্থ কল্যাণ করতে পারে না। তাই সাময়িক গুণ ও কর্ম দেখে
ব্যক্তির পরিচয় জানা খুব কঠিন। সেজন্য, সমাজে এখনও বাবা-মায়ের পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে।“
শ্রী শঙ্করদেবের মানবতাবাদের প্রসং ধরে বাবাজী মহারাজ বলেছেন – প্রকৃত বৈষ্ণবের
কোন জাত নেই, শত্রু নেই, তিনি মানবতার পূজারী। এই অর্থে প্রত্যেক সৎ ব্যক্তিই বৈষ্ণব। ভগবানের ভক্ত বা সত্য শিব সুন্দরের পূজারী ব্রাম্ভন নন, ক্ষত্রিয় নন, শূদ্র নন, খ্রীষ্টান নন – তিনি ভক্ত। পৃথিবীটাকে
সুন্দর করার জন্যই তারা জীবন ধারণ করেন।