বাবাজী মহারাজ, অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন ‘তুমিত্ব’বাদে।

  


তারক ঘোষ

বাবাজী মহারাজ, অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন তুমিত্ববাদে। আর একটি আমিত্বে বিশ্বাস করতেন - সেটি হল সূক্ষ 'আমি' - সদ, আনন্দস্বরূপ।  সকলকে তাই বলতেন, যদি ত্যাগ করতে হয়, তাহলে তোর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্থুল  আমিত্বটাকেই আগে ত্যাগ কর। দেখবি সব অহঙ্কার কোথায় চলে যাবে।

 যে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আজ মন ভরে যাচ্ছে, মনের মধ্যে আমি করেছিবলে অহঙ্কার হচ্ছে, সেই বাড়ির দরজা দিয়েই তোকে একদিন চলে যেতে হবে চিরকালের জন্য। বাড়িটার মালিকানাও বদলে যাবে। একদিন সেই সাধের বাড়িটাও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। যেখানে তোর নিজের দেহটার মালিক তুই নয়, সেখানে কিসের আমিত্ব? কাজেই ত্যাগ, অতি কঠিন বস্তু আর আমিত্বত্যাগ আরো কঠিন। বাবাজী নিজে কোনদিন বলতেন না, ‘আমি দেখছি, আমি আশির্বাদ করছি, আমি আছি তোর জন্য। 




বাবাজীকে ভক্তরা যখন বলতেন, বাবা, ছেলেটার কিছুতেই শরীরটা সারছে না, আপনি ওকে আশির্বাদ করুন, যাতে সুস্থ হয়ে যায়। বাবাজী বলতেন, আমি ভগবানের কাছে নিবেদন করব। আসলে, ‘আমির একটাই কাজ, ভগবানের কাছে  সবকিছু নিবেদন করা। বাকিটা তিনি করবেন। 

কর্ম করা, কিন্তু ফল তাকেই অর্পণ করা। কিন্তু মনে রাখতে হয়, ঈশ্বর সেই ব্যক্তির কর্মফল, তাকেই ফিরিয়ে দেন। কাজেই মনে রাখবেন, কোন ধরণের কর্ম আপনি করবেন, কারণ, ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত ফলআপনার একাউন্টেই জমা থাকবে। সুদেও বাড়বে। নিতে আপনাকে হবেই।

 আর একটা দিক আছে এই আমির। সেটা উপলব্ধি করা অতি কঠিন। এই আমির স্বরূপ সম্পর্কে কান্ট বলেছেন – Unknown and unknowable. বাবাজী লিখছেন, “এই আমিহল সৎ সৎ শব্দের অর্থ হল অস্তিত্ববান। এটা চৈতন্যময়। এই আমিহল আনন্দস্বরূপ। এই আনন্দই কৃষ্ণ, এই আনন্দই আত্মা, এই আনন্দই দুর্গা। বিজ্ঞানের ভাষায় সবকিছুর মূল কারণ। 




যখন, এই আমি আনন্দ রূপে দেহে আবদ্ধ, তখন জীবাত্মা। আর যখন বিশ্বরূপে জগতে ব্যপ্ত, তখন পরমাত্মাএই আমি নিজেই দ্রষ্টা, আবার নিজেই দ্রষ্টব্য।সোজা ভাষায় কর্তা ও কর্ম। খুবই জটিল বিষয়। যারা আমি তে বিশ্বাসী, তারা মনে করুন, আপনার আমিআর আপনি এক নন। 

বাউল সাধকদের কাছে এই আমি হল মনের মানুষ। যিনি তার মনের মধ্যেই প্রতিবেশীর মতোই বাস করেন, কিন্তু তার কাছে যাওয়া খুব কঠিন। তাদের কাছে এই মনের মানুষহল ঈশ্বর। আমরা সবাই জানি, যারা সাধু মানুষ বা যারা সন্ন্যাস অবলম্বন করেছেন, তারা সবাই ত্যাগী পুরুষ। ঘর-সংসার, নিজের নাম, অভিমান, অর্থ সবকিছু ত্যাগ করে আসে পরমার্থ পাওয়ার বাসনায়। কারণ, বাবাজী বলতেন সাধকের কাছে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সবচেয়ে বড় বাধা হল টান’ – সেই টান, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া যেন, আর কিছুর প্রতি না থাকে। 

তিনি বলেছেন – “সাধু যদি জপ, ধ্যান না করে বা ঈশ্বরকে না ডাকে তবে কেবলমাত্র বৈরাগী, মহন্ত পদবী বা জটাদাড়ি, বেশভূষার দ্বারা সে যথার্থ সাধু হতে পারেন না।বাবাজী কেন বলতেন, ‘সাধু হওয়া খুব কঠিন কাজ, সাধুদের বড় কষ্ট।বলতেন অনেক কষ্টে। যে কষ্ট শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ পেয়েছিলেন, বাবাজীকেও সেই কষ্ট একসময় আঁকড়ে ধরেছিল। 

বাবা বুঝেছিলেন, কোথায় একটা ভুল হচ্ছে। শ্রীরামদাসজী মহারাজ চাইতেন না আশ্রমের বিস্তার হোক, দাদাজী মহারাজও বিলাস-ব্যসনহীন ভাবে সর্বত্যাগী রূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে গেছেন, সাধকের জীবনে যদি বিলাসিতা এসে যায়, সাধক তার পথ থেকে পতিত হয় বলে মনে করতেন বাবাজী মহারাজ। গুরুর ত্যাগব্রত শিষ্যকে চালিত করবে ধর্মপথে, কিন্তু গুরু যদি অর্থ ও নামের পথে ছুটে চলেন, আশ্রমে দান করা বে-আইনি অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করেন, তাহলে, তিনিও অজান্তে সেই পাপের পথে পা দেন। কারণ, সবার উপরে আছেন ভগবান, যার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় কারো নেই। 

সংসারের মঙ্গল কামনাই সাধকের ধর্ম। আর গুরুর ধর্ম হল শিষ্যকে পাপের হাত থেকে মুক্ত রাখা। খুব কঠিন এই আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সন্ন্যাসী বা গুরু হয়ে ওঠা। তাই বাবাজী বারবার সাবধান করতেন। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad