No title

ধারাবাহিক রম্য-রচনাঃ প্রথম কিস্তি

শকুনিমামার সমাজ-দর্শনঃ সব লুটে লে রে ভাই, সব লুটে লে… 

 তারক ঘোষ 

 এই রচনার সমস্ত চরিত্র, স্থান লেখকের কল্পনা-প্রসূত। এখানে বর্ণিত ঘটনাগুলি ও রচনার সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক এবং জীবিত বা মৃত প্রকৃত ব্যক্তির সাথে যদি, কোথাও কোন মিল থেকে থাকে, তা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। 

 মি শকুনি। লোকে আমায় ভালোবেসে শকুনিমামা বলে ডাকেন। বেশ ভালোই লাগে। তবে, প্রথমেই আপনাদের একটা ভুল ভেঙে দেওয়া দরকার। সেটা হল, আমি মহাভারতের সেই শকুনিমামা অর্থাৎ মাতুল শকুনি নই। আমি হলাম এই ভারতের নানা ভাগাড়ের পাশে গাছের মগডালে বসে থাকা সেই আদি ও অকৃত্রিম শকুনি, মানে ইঞ্জিরিতে যাদের ভালচার বলে। 
তবে, জানিনা, আর কদ্দিন টিকে থাকবো? আপনাদের কল্যাণে আমাদের সংখ্যা কমতে কমতে হাতে গোনা যাচ্ছে। কিছুদিন পর আর সেটাও কষ্ট করে গুণতে হবে না। এই যে এদিকে তাকিয়ে দেখুন, গাছের মগডালে আগে আমাদের মেলা বসে যেত। খাবার নিয়ে কী টানাটানি। 
আর এখন, মাত্র তিনজন – আমি, আমার বুড়ি বউ আর একটা কোথাকার হাড়গিলে শকুনি, এসেছে যখন তাড়িয়ে তো আর দিতে পারি না।
এই তো বছর খানেক আগের কথা- না খেয়ে প্রায় মরতে বসে ছিলাম। কেন জানেন? আপনারা জানেন মশাই, লজ্জায় বলতে পারছেন না। কীর্তিধররা তো আবার আপনাদের মানুষ নামের মহা-বুদ্ধিমান প্রাণীরা। খুলেই বলি, মনে পড়ে যাবে। 
যে ভাগাড়ের ধারে আমার বাসা, সেখানে মরা কিছু পড়ার উপায় ছিল না। একদল লোক এসে নিয়ে চলে যেত। মরা ছাগল, মুরগী, হাস, শেয়াল কিচ্ছু বাদ যেত না। বুঝতে পারছিলাম না, একদল ফেলে যাচ্ছে, আর আমরা খেতে যাবার আগেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কী হল ব্যাপারটা? 
ব্যাপারটা জানালো আমাদের সঙ্গের ওই হাড়গিলে শকুনটা, ওকে আমরা রিপোটার বলে ডাকি।
 সেই খবড়টা দিল। বলল, "জানো মামা, শহরের কিছু রেষ্টুরেন্টের মাংস সাপ্লাই হয় এখান থেকেই।" অবাক হয়ে আমার বুড়ি বলল – সে কীরে হাড়গিলে, সে আবার কী? -
"হ্যাঁ গো মামী সস্তা হবে বলে, কিছু লোক, এখানকার মড়াগুলো কেটে মাংস হিসাবে বেশ কিছু হোটেলে-রেষ্টুরেন্টে সাপ্লাই দিত। ধরা পড়ে গেছে।"

 
বাঃ, দারুণ বুদ্ধি তো মানুষের! আমাদের তো ভাতে মারার ব্যবসাটা করেই ফেলে ছিল। ভাগ্যিস ওই উর্দিপরা পুলিশগুলো আছে। নইলে কী যে হত। 
তবে, হাড়গিলের কথাটা শুনে মনে মনে বেশ একচোট হেসেছিলাম। 
আসলে, তখন আমার চোখের সামনে একজোড়া তরুণ-তরুণী। প্রেমে বিভোর। রেষ্টুরেন্টের আধো আলো-অন্ধকারে চিকেন-মাঞ্চুরিয়াম মুখে ফেলে একটু আধটু চুমু-টুমু খাচ্ছিল। তা খাক, কিন্তু, চুমুটা মানে কিসটা কীসের সঙ্গে খাচ্ছিলিস যদি জানতিস, তখন চুমু না খেয়ে বমি করতে ছুটতিস। 
ভাগাড়ের মাংস দিয়ে প্রেম! 
বলিহারি কপাল তোদের! 
যাক, ওসব পুরানো কথা। এখনকার কথা শুনুন। সেদিন, এ ভাগাড়, সে ভাগাড় ঘুরছি। আজকাল তো সবজায়গাতেই ভাগাড় হয়ে গেছে। তাই আর ভাগাড় খোজার জন্য উড়ে বেড়াতে হয় না। আচমকাই দেখা, খগেনের সঙ্গে।
 ওরে বাবা, ব্যাটা খেতে পেত না। রাস্তার ধারে দোকানে বসে বাসন মাজতো। এখন তো চেনাই যায় না। গাল একেবারে কাশ্মীরি আপেল হয়ে গেছে, হাল্কা বড়লোকী ভুঁড়ি নেমেছে। আট আঙুলে আটটা আংটি। গলায় দেবতাদের মতো সোনার হার। বাপরে বাপ। দু হাতে দুটো মোবাইল। 
একটা কানে উঠছে, আর একটা হাতে থাকছে। আবার অন্যটা কানে উঠছে। 
 আমার ভাগ্যটা ভালো, ফোনাফুনির মধ্যেই চোখ পড়েছে আমার উপর। 
ব্যস! একেবারে লাফিয়ে আমার সামনে – “আরে মামা যে! কেমন আছ?” 
আমি ওকে আড়চোখে মেপে নিয়ে বললাম –“খগেন, তোর একি রূপ! 
এ যেন গীতার সেই বিশ্বরূপ দর্শন করছি।
" তুই খগেন তো? মানে আমাদের বাসন-মাজা খগেনই তো?” 


খগেন একটা বশ্রি রকম খিস্তি মেরে বলল, “তবে নয় তো কী! তবে, শকুনি মামা, সবই তোমার দয়া। যেদিন খেতে না পেয়ে ভাগাড়ের ধারে বসেছিলাম।
 তুমি বলেছিলে – “এখানে কেউ কিছু তোকে দেবে না। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে বলবে সব তোর কর্মফল। বড় বড় কথা শোনাবে, বলবে, সয়ে যা সব পাবি।“ 
তোমার কথাগুলো ভালো লাগছিল। 
তারপর তুমি আচমকাই ডানা ঝাপটে বলেছিলে। “লুটে নে খগেন, লুটে নে। ধর্ম পরে হবে, আগে লুটে নে।“ 
ব্যাস তোমার কথাকে গুরুবাক্য মেনে লুটতে শুরু করলাম। প্রথমে, দু-একটা প্রাণ লুটলাম। 
তারপর দু –চারটে মেয়ের ইজ্জত লোটার পর দাদাদের নজরে পড়ে গেলাম। 
এরপর আর আমায় পায় কে! দাদাদের কথায় শুরু হল নতুন লুট – চাকরি লুট। মামা সে যে কী জিনিষ তুমি বুঝবে না। যে ব্যাটা খেটে-খুটে পরীক্ষা দিল, তার চাকরি লুট। পেল কে? গোবলা- পরীক্ষা না দিয়েই। এখন ব্যাটা হেডু হয়ে বসে আছে একটা স্কুলে।
চলবে...

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad