আমাদের পাশে শ্রীগুরুদেব আছেন, এটা সত্য; আমরা শ্রীগুরুদেবের পাশে আছি – এটা কতটা সত্য?

বাবাজী মহারাজ ‘গীতা-চিরন্তনে’ র একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখছেন –“বেশিরভাগ মানুষ সাংসারিক বিষয়সুখ যাতে আরো বাড়ে, তার জন্য ঈশ্বরচিন্তা করে অর্থাৎ মোহ যাতে আরো বাড়ে, তার জন্য। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাই গীতার বীজ। যদি সাংসারিক সুখ না বাড়ে,সাংসারিক দুঃখ না কমে, তবে আমরা বলি ভগবানকে ডাকার দরকার কি?”

 তারক ঘোষ 

পর্ব ৪৩ 

মার্জনা করবেন পাঠকগণ! আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, কারো ভাবাবেগে আঘাত করার জন্য নয়, কারো সমালোচনা করার জন্য নয়, কারো ‘ঘুম’ ভাঙানোর জন্য নয় – এটা আমার আত্মবিশ্লেষণ। আর এই আত্মবিশ্লেষণ থেকে প্রতিদিন নানা কথা উঠে আসে। সেটাই লিখি। 
বাবা যে আমাদের এত বিশ্বাস করে প্রবচন শোনাতেন, একটা আশা নিয়ে যে আমরা তার কথা শুনে নতুনভাবে নিজেকে চিনব, সেইভাবে সন্তানদের গড়ে তুলব যাতে একটা নতুন সমাজ তৈরি হয়। বুদ্ধদেব মানুষের যন্ত্রণার মুক্তি খোঁজার জন্য রাজপ্রাসাদের সুখ, স্ত্রী-সান্নিধ্য, সন্তান ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তার নিজের সুখের জন্য নয়, মানুষ যাতে নিজেকে চিনতে পারে, তার জন্য। 
প্রভু যীশু, ক্রুশ-বিদ্ধ অবস্থাতেও বলে গিয়েছিলেন –“প্রভু, তুমি ওদের ক্ষমা কোরো, ওরা জানে না ওরা কী করছে।“
গতকাল 'জপপূজা ধ্যানভক্তি সমাধিমুক্তি' এর একটা পোস্ট পড়ছিলাম।
 তিনি লিখছেন – “রাময়ণ শিখিয়েছে কি কি করা উচিত । মহাভারত শিখিয়েছে কি কি করা উচিত নয় । আর ভাগবত শিখিয়েছে জীবনে কেমন মানসিকতা নিয়ে চললে ভগবানের কৃপা, লীলা, মধুর জীবন পাওয়া যায়। শ্রীবাবাজীর স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখছেন –প্রবচনে বসে বাবাজী বলছেন, “যতক্ষণ আমার সামনে বসে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, যেই বেরিয়ে যাবে সব ভুলে যাবে । আমার গুরুদেবের সাবধান বাণী শোনেনি । আমিও শুধু বলে যাচ্ছি” 
সংসার আছে, থাকবে। সংসার আমাদের আনন্দ দেবে, কষ্ট দেবে। সংসার যা দেবে না, তা হল – কষ্ট থেকে মুক্তির উপায়। সেটা দিতে পারেন একমাত্র ভগবান ও সদগুরু। 
বাবাজী বলতেন –“হাজার সাধু শিষ্য পাওয়া যতটা সহজ, একজন সত্যিকারের গৃহী-শিষ্য পাওয়া খুব কঠিন।“ 
কেন বলতেন? 
তার এই বলার পিছনে নানা কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল, তিনি বুঝতে পারতেন, দীক্ষা নেওয়ার জন্য একশ্রেণির গৃহী মানুষ যতটা ছটফট করেন, গুরুর আদেশ পালনে ততটাই নিষ্ক্রিয় থাকেন। দীক্ষা পাওয়া হয়ে গেলেই খুশি “আমার বাবা আছেন। তিনিই দেখবেন।“ এ
কেবারে সত্য কথা। কিন্তু, আমরা কি ভাবি, “আমার তো বাবাজী আছেন, বাবাজীর কাছে আমরা সত্যিই আছি কি?”
দীক্ষা যখন নিয়েছি, শ্রীগুরুদেবকে পিতা বলে মেনেছি, ঋষিকূলে যখন আশ্রয় মিলেছে, তখন সেই ‘পিতার’ প্রতি আমরা কি সন্তানসুলভ আচরণ করতে পারছি! নিজেকে প্রশ্ন করুন। 
আমাকে এক গুরুভাই বলেছিলেন – “গুরু নির্দেশিত পথে চলাই হচ্ছে, তার প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন। তার লিখে যাওয়া বই পড়াটা আমাদের একমাত্র কাজ নয়, তার লিখে যাওয়া উপদেশকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করাটাই হচ্ছে আসল কাজ।“ 
বাবাজী মহারাজ ‘গীতা-চিরন্তনে’ র একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখছেন –“বেশিরভাগ মানুষ সাংসারিক বিষয়সুখ যাতে আরো বাড়ে, তার জন্য ঈশ্বরচিন্তা করে অর্থাৎ মোহ যাতে আরো বাড়ে, তার জন্য। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাই গীতার বীজ। যদি সাংসারিক সুখ না বাড়ে,সাংসারিক দুঃখ না কমে, তবে আমরা বলি ভগবানকে ডাকার দরকার কি?” 
আমাদের মধ্যে অনেকের মনেই এই ধরণের একটা ভাবনা কাজ করে। অর্থাৎ ‘গিভ এন্ড টেক’।
 দাও আর নাও। 
তুমি আমাকে সুখের সন্ধান দাও। আমার মেয়ের বিয়ে, ছেলের চাকরি, রোগভোগ থেকে মুক্তি দাও, বিনিময়ে ঘর আলো করে, জাঁকজমক করে তোমার পুজো করব। পাশের বাড়ির রতনবাবুকে দেখিয়ে দেব, আমি কতবড় ভক্ত। আলো, ফুল আর প্রসাদে পাহাড় গড়ে দেব, লোকে দেখে ছোখ ছানাবড়া করে ফেলবে।
পাঠকগণ, এগুলো আমি দেখেছি। এখনো দেখি – একজন ধনী শিষ্য (সবাই এক নয়।) কীভাবে অর্থের অহঙ্কার নিয়ে, বাবাজীর অনুষ্ঠান করেন, আর একজন গরীব ভক্ত, সামান্য দু-একটা ফুল নিয়ে চোখের জলে তার পুজো করেন। এসব দেখে মনে হয়, বাবার অনুষ্ঠান করতে গিয়েও আমরা সেই অহঙ্কারটাই আঁকড়ে ধরে আছি!
 অথচ, বাবা বলতেন – অহঙ্কার সবচেয়ে বড় শত্রু। ওকে আগে ধ্বংস কর। 
আমি দেখেছি, বাবার কিছু ধনী শিষ্য বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কীভাবে বলতেন। কীভাবে, অন্য গরীব গুরুভাই-বোনদের দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে দেখতেন, যখন সেই গরীব ভক্তরা বাবাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে যেতেন। 
প্রাচুর্য্যের অহঙ্কারে মত্ত সেই শিষ্যরা আজ কোথায়? বাবা পার্থিব দেহ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, তারা কী করেছেন বাবার স্মৃতি, তার প্রবচনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য? 
খুব জানতে ইচ্ছে করে। 
কেন জানেন? একশ্রেণির ধনী শিষ্যদের দেহধারী গুরুদেবের জন্য যতটা আগ্রহী ছিলেন, ‘বিদেহী’ গুরুদেবের জন্য নয়। 
আমার মনে হয়, একটা স্বার্থ ছিল একশ্রেণির ধনী শিষ্যদের। আমি সবাইকে বলছি না। আমি তাদের বলছি, যারা বে-আইনি পথে উপার্জিত ‘কালো টাকা’ ‘সাদা’-করার জন্য আশ্রমে ‘দান’ করেন, তাদের কথা। নিজেও পাপ করেন, ক্রিমিন্যাল অফেন্স করেন আর গুরুদেবকেও সেই পাপের ভাগী করার চেষ্টা করেন।
আজ সেই একশ্রেণির ধনী শিষ্যরা কিন্তু আছেন, ক্ষেত্র বদলেছেন। কারণ, এদের অনেকেই আশ্রমে ‘দান’ কে ইনভেস্ট মনে করেন। আমি কাউকে আঘাত করছি না। আশ্রমে দান করা পবিত্র কর্ম। কারণ, ভক্তদের দানের টাকাতে, জমিতেই আশ্রম চলে। ফলে, ভক্তদের আশ্রমের উপর একটা অধিকার (আইনি না হলেও) থাকে। অধিকার বলতে আমি বলতে চাইছি, সেই আশ্রমে যাওয়া, প্রসাদ পাওয়া বা থাকার। 
অনেকে, এটা মনে করেন না। তাই কিছু ভক্ত আশ্রম থেকে ব্যথিত মনে ফিরে আসেন। যারা ভক্তদের সঙ্গে এই আচরণ করেন, তাদের মনে রাখা উচিত বাবাজী মহার নিজের পাওয়া প্রসাদকেও অভুক্ত ভক্তের জন্য আনন্দ মনে তুলে দিতেন। 
যাইহোক, সেসব কথা তুললে, অনেক বড় বড় কথা উঠে আসবে। অনেকে তখন, এই অধমের লেখার নীচে ইংরাজীতে বড় বড় কথা লিখবেন। না জেনে, না বুঝে। 
যেটা বলছিলাম – আশ্রমে দান করা মহৎ কাজ।কিন্তু, অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ দান করাটা নয়। আমি বাবাকে একবার বলতে শুনেছিলাম। তিনি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের এক ভক্তকে বলছেন, ‘আমি ওটা রাখবো না, তুই অন্যকে দিয়ে দে।“ সব ঘটনাটা সময়ে জানাবো, এখন নয়। তাই এটুকুই লিখলাম। 
সেদিন, বাবা জানতে পেরেছিলেন, ওই ‘ভদ্রলোক’ চুরির (ছোট চোর ভাবনেন না, অনেক বড় চোর) টাকায় বাবাজীকে কিছু একটা দিয়েছিলেন। 
বাবা জানতে পেরে, সেটা ফেরত নিতে বলেন। আমার কষ্ট লাগে, এক শ্রেণির ভক্তরা বাবাকে বার বার পাপের ভাগী করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কখনো অজান্তে, কখনো জ্ঞানত। তাকে ঠকিয়েছেন। অবশ্য, আজ দেখি, বাবা ঠকেন নি, তারাই ঠকে গেছেন, মনের মধ্যে একটা ভয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। 
চলবে

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad