বাবাজী মহারাজ অন্যান্য সন্ন্যাসীদের মতোই থাকতে পারতেন, তাহলে সমাজ-সংষ্কারে এগিয়ে এলেন কেন?



এদের মধ্যে ছিলেন এক মুসলমান মহিলা। যিনি বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘বাপজান, এখন খেয়ে নে, পরে বড় হয়ে জাত-পাত মানিস।‘ এই শিক্ষা তিনি রেখে দিয়েছিলেন তার চেতনার গভীরে
সাংবাদিক হিসাবে ভারতের বহু ধর্মীয় মেলা কভার করার সৌজন্যে বহু সাধু-সন্ন্যাসী দেখেছি, শুনেছি তাদের জীবন দর্শনের কথা। আসল আর নকলের সমারোহ দেখেছি কখনো কুম্ভে, কখনো সাগরে, কখনো জয়দেবে, কিংবা পাথরচাপুড়িতে। জীবনের তাপে পুড়ে যাওয়া মানুষের শান্তি পাওয়ার কাতর আর্তনাদ শুনেছি। দেখেছি, তাঁবুতে তাঁবুতে আদিম ব্যবসা। 
 পাপ আর পূণ্যের মেলায় আসল সত্যকে খুঁজে বেরিয়েছি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন লেখার জন্য। অমৃত কুম্ভের মাঝে উঠে আসা হলাহল দেখে শিউরে উঠেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, এই কি ধর্মের আসল সত্য! সনাতন ধর্মের আসল রূপ তো এটা নয়। তাহলে, কেন? কেন, ধর্মের আড়ালে চলছে অধর্মের খেলা? 
 প্রশ্ন শুধু আমার একার নয়। যে সমস্ত সাংবাদিকরা কুম্ভ কভার করেছেন, তাদের সকলেই জানেন, এখানে এমন কিছু অন্যায় কাজ হয়, যা জানলে, সাধারণ মানুষ চমকে উঠবেন। কিন্তু, এটা আমাদের সনাতন ধর্মের আসল রূপ নয়। যারা পাপকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই দায়িত্ব তাদের।
শ্রীবাবাজী মহারাজের সঙ্গে শ্রীবিষ্ণুদাস ও শ্রীরাধামাধবদাস

আবার এমন হাজার হাজার সন্ন্যাসী দেখেছি, যারা সত্যি কামনা-বাসনাহীন। নেই কোন আশ্রম, নেই স্থায়ী কোন ‘রোজগার’। শয়ন গাছতলায়, পর্বতের কোন ঢালে, পাতার কুটিরে। সাধনায় ব্রতী এই সাধকরা কখনো প্রচারের আলোয় আসেননি। জীবন সম্পর্কে উদাসীন থেকে কী এক অজানা আকর্ষণে ভেসে চলেছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে… 

কবিগুরু বলেছেন— “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে 
 আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে 
সকলের তরে সকলে আমরা
 প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।।“ 

শ্রীবাবাজী এই ‘পরের তরে’ অর্থাৎ অপরের জন্য শব্দ-বন্ধকে ভীষণ গুরুত্ব দিতেন। আর দিতেন কেন? সব সাধু-সন্ন্যাসীরা তো তা করেন না। ঈশ্বর আর আশ্রম নিয়েই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন। সমাজের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় তাদের তো কই ভাবায় না!
 শিষ্যকরণ কিংবা জপ-তপ-পূজা-ভজন এর মধ্যেই নিজের আবদ্ধ রাখেন। কেউ কেউ ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, কেউ বা আশ্রমের সমৃদ্ধি, বিত্ত বাড়ানোর সাধনা করেন। সমাজের কীসে মঙ্গল হবে, মানুষের কষ্ট কীভাবে দূর হবে, তা নিয়ে তাদের খুব একটা ভাবিত হতে দেখা যায় না। আর এখানেই আমাদের বাবাজী মহারাজের সাফল্য। তার কাছে ঈশ্বরও সত্য জগতও সত্য, তাই এই জগত ও জাগতিক প্রাণকেও তিনি আপন করে নিতে পেরেছিলেন। 
সমাজ যেহেতু, মানুষকে নিয়েই, তাই সমাজের মঙ্গল কামনায় মানুষের আর্থিক ও পারমার্থিক উন্নতির উপায় অনুসন্ধান করে গেছেন তিনি আজীবন।
বাবাজী মহারাজ মিডিয়ার যেমন সমালোচনা করেছেন, আবার তার গুরুত্বকেও স্বীকার করেছেন। তিনি বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছেন – সুস্থ সমাজ গঠনে মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে। তারাই পারে জনমত গঠন করতে। 
আমরা যদি ফিরে যাই বাংলার ধর্মীয় নবজাগরণের দিনগুলোতে, তখন দেখতে পাবো সারি সারি অনেক মুখ, যাদের আদর্শ, ন্যায়-নিষ্ঠা ভারতের ধর্মীয় আদর্শকে বহু উর্ধে তুলে ধরেছে। তারা শুধু ধর্মের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন নি, নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই মানব-সমাজে। 
শ্রীচৈতন্যদেব, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ সহ বহু মহাপুরুষের জন্যই আজ বাংলার মাটি পূণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এনারা ব্যক্তি মোক্ষলাভের বাসনায়, নিজেদের জগত-বিমুখ করে রাখেন নি। আপনারা দেখেছেন, কীভাবে, মানুষের সমাজে সমস্যা এলে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 

বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন – তিনি তার জ্ঞান দিয়ে এই জগতের, সমাজের মধ্যে চেতনা ফেরাবার চেষ্টা চালাবেন। আপনারা অনেকেই জানেন, প্রথাগত ধর্মীয় ব্যবধানকে তিনি গুরুত্ব দিতেন না। তার কাছে, সকল ধর্মীয় গুরুরা একই মর্যাদা পেতেন।
 তিনি তার স্কুল শিক্ষককেও সম্মান জানিয়ে নত হতেন, আবার শ্রীগুরুর কাছেও নত হতেন। জ্ঞানীদের সম্মান করতেন আবার জ্ঞানহীনদের চেতনার উন্নতির জন্য কাছে টেনে নিতেন। তার কাছে কেউ পর ছিল না, তার কাছে সব ধর্মই ছিল সমান। তার কাছে জাতের ভেদাভেদ ছিল না। 
তিনি উঠতে পেরেছিলেন, জাত-পাত, ধর্মীয় কুসংষ্কারের অনেক উর্ধে। কিন্তু, কেন তার এই সমাজ ভাবনা? এই সমাজ ভাবনা, জাত-পাতের কুসংষ্কার সম্পর্কে শিক্ষার একটা অংশ তিনি পেয়েছিলেন তার স্কুলের মাষ্টারমশাই মোজ্জামেল হক সাহেবের কাছ থেকে। 
মোজাম্মেল সাহেব স্কুলের লাইব্রেরী থেকে রামায়ণ-মহাভারত এনে বাবাজীকে বলতেন – তুই ব্রাম্ভণের ছেলে, এগুলো পড়। তিনি বাবাজীকে বই-খাতা-পেন কিনে দিতেন। একবার বাবাজীর বৃত্তি পরীক্ষার সময় মোজাম্মেল সাহেব ডাব হাতে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন বাবাজীকে ডাব খাওয়াবেন বলে। বাবাজী পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে প্রশ্নপত্র দেখাতে গেলে মোজ্জামেল সাহেব বলেন – ওটা পরে দেখবো, আগে ডাব খা। 
এটাই তো মানবিকতা, মানুষ যে জন্য। কোথায় জাত! কে ব্রাম্ভণ, কে মুসলমান!
এছাড়া, তিনি বেশ কয়েকজন মানুষের কথা কখনো ভোলেন নি। এদের মধ্যে ছিলেন এক মুসলমান মহিলা। যিনি বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘বাপজান, এখন খেয়ে নে, পরে বড় হয়ে জাত-পাত মানিস।‘ 
এই শিক্ষা তিনি রেখে দিয়েছিলেন তার চেতনার গভীরে। তিনি ভোলেননি তার স্কুল শিক্ষক সিদ্ধেশ্বরবাবুর কথা, যিনি বাবাজী মহারাজকে বলেছিলেন- ‘তোর যা জামা-কাপড় লাগে, আমি দেব।‘ তার মনে ছিল, প্রীতিদির কথা, যিনি নিজের ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে বাবাজীকে কোলে তুলে নিতেন। 
কীভাবে বাবাজী সমাজের এই মানুষগুলোর কথা ভুলতে পারেন! মোজ্জামেল হক, কিংবা ওই মুসলিম মহিলা তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন, আসল সত্য হল মানবতা। জাত বাহ্যিক একটা পোশাক। ‘কালো আর ধলো, বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা।‘
শ্রীবাবাজী মহারাজের সঙ্গে অমিতাভ নায়েকের ভাগিনা

বাবাজীর স্কুল জীবনে ও তার পরবর্তী জীবনে শিক্ষক বাসুদেব বন্দোপাধ্যায়, সুভাষবাবুর ভূমিকাও কম ছিল না। মেমারীর নায়েক পরিবার চিরকালই কাঠিয়া সম্প্রদায়ের ছায়ায় ছিলেন। এই পরিবারের অমিতাভ নায়েক ছিলেন বাবাজীর সহপাঠী। 
বাবাজী মহারাজ তার চেয়ে এক বছরের বড় ছিলেন বলে জানা যায়। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবাজী মহারাজ এই নায়েকদের কোল্ড স্টোরেজে তার সাইকেল রেখে যেতেন, আবার ফিরে আসার পর, সাইকেল নিয়ে আশ্রমে ফিরতেন। 
বাবাজী তখন বড়র আশ্রমে শ্রীশ্রী জানকীদাসজীর ছত্রছায়ায় ছিলেন। যেদিন রাস্তায় কাদা হত, বাবাজী মহারাজ মেমারী থেকে হেটে আশ্রমে ফিরতেন। শ্রীশ্রী জানকীদাসজী বাবাজীর মনে গেঁথে দিয়েছিলেন এক আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন। 
তাই নিজেই ঠিক করেছিলেন বাবাজী মহারাজের পিএইচডির বিষয় কী হবে। চলবে…

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad