বাবাজী বলতেন, এতটা পথ যখন, সাধন করলি, জীবনের বাকি দিনগুলো করে যা, রাত তো শেষ হবার পথে

 





বাবাজী মহারাজের বাগ্মিতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও পাণ্ডিত্য তাকে গুরুদেব থেকে স্পিরিচুয়াল সায়েন্টিস্ট এ পরিণত করেছিল. ধর্ম পথে চলার ফল ‘ইন্সট্যান্ট’ আসে না, কিন্তু আসে।

 

তারক ঘোষ


ভারতীয় সনাতন ধর্ম, শ্রীগীতার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অর‍্যাধুনিক বিজ্ঞান, যে বিজ্ঞানকে আজও করায়ত্ব করতে পারেন নি বিশ্বের বিজ্ঞানী। প্রতিটি তত্বের মধ্যে আছে জীবন ও বিশ্বের বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর। পরবর্তীকালে নানা সংযোজনের ফলে, কোথাও কোথাও কিছু ‘অপবিজ্ঞান’ ঢুকেছে, এসেছে ধর্মের মধ্যে নানা কুসংষ্কার। এগুলোকে বাদ দিলে আজও এই সনাতন ধর্ম মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। শুধু পালন করে যেতে হয়।

বাবাজী বলতেন, ‘আমি দীক্ষা দিলাম। যদি মানতে পারিস, তবে আসিস। আর না মানতে পারলে আসিস না।‘

এই ‘মানা’ অর্থাৎ পালন করা খুব কঠিন জিনিস। কেননা, ধর্ম পথে চলার ফল ‘ইন্সট্যান্ট’ আসে না, কিন্তু আসে। আজ আপনি একজনকে সাহায্য করলেন, তার অসহয়ায় অবস্থায় সমদরদী হয়ে। নিছক পূণ্য করার লোভে নয়, বা আপনার দান করার ক্ষমতা আছে – এই দম্ভ থেকে নয়, সমদরদী হয়ে। দেখবেন, আপনিও কোন না কোনদিন, অযাচিতভাবে এমন সাহায্য পাবেন, যে সাহায্যটা সেই মুহুর্তে আপনার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।





বাবাজী মহারাজ নিটনের তৃতীয় সূত্রের কথা উল্লেখ করে বলতেন – প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ‘তুই বাবা-মাকে প্রণাম করিস না, ধর্ম পথে চলিস না, সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে বলিস, ভগবান নেই। আরে বাবা, ভগবানকে মানিস না বলার আগে ভাব, ভগবানকে না মানার যোগ্যতাও তোর আছে কি না।‘

আসলে, না মানার জন্যও একটা যোগ্যতা লাগে। সব জিনিসকে চুম্বকে পরিণত করা যায় না। চুম্বক করতে হলে লোহা লাগে, ভালো চুম্বক করতে ইস্পাত লাগে। কাঠকে চুম্বকে পরিণত করা সম্ভব নয়। তেমনি, ভগবানকে দর্শন করতে হলে, সেই দর্শন করার মন তৈরি করতে হয়। সবাই এটা পারে না। যারা পারেন, তারা সংসারে থেকেও হয়ে যান যোগী।

তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষা তুলে ধরে বলেছেন –“দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমায় নাহি ডরাব হে/যেথায় ব্যথা সেথায় আরও নিবিড় করিয়া ধরিব হে” –যে সর্বনাশের পরও আশা ছাড়ে না তার কাছে তিনি আসেন, ভক্তকে আলোর জগতে এনে একাত্ম করে নেন। 


 


বাবাজী বলতেন, এই মহাবিশ্বের রহস্য লুকিয়ে আছে মায়ের গলায় ৫১ টি মুন্ডের মালা, কিংবা ৫১ টি সতীপীঠ এর মধ্যে। এই মহাকাশেও রয়েছে ৫১ লক্ষ গ্যালাক্সী। বিজ্ঞানীরা জানেন, মহাভারতের ভারত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কোন অবস্থায় পৌছেছিল। আর আমরা, কিছুই না জেনে বলে দিচ্ছি ভগবান মানি না। আগে ভগবানকে দেখাও, তারপর মানবো।

বাবা হেস বলতেন, তুই জলের মধ্যে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন দেখাতে পারবি? তার জন্য রাসায়নিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন, একটা ল্যাবরেটরী দরকার। তেমনি ভগবান মিশে আছেন এই জগতের প্রতিটি বস্তু ও জীবকণায়। এটাই ‘Unity in diversity’ একের মধ্যে বহুত্ব ও বহুর মধ্যে এক। ভগবান না থাকলে, কে করল, এই বিরাট মহাবিশ্ব? কে রঙ আনলো প্রজাপতি আর ফুলে?  জগত সত্য বলেই ঈশ্বরও সত্য। তোরা না চিনলি জগতকে, না চিনতে পারলি ঈশ্বরকে।

জীবনে আর একটা কথা মনে রাখার কথা বাবাজী মহারাজ বলতেন। জীবনের প্রতিটি ভাগের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য্য আছে। এই সোউন্দর্য্যকে অস্বীকার করা ঠিক নয়। শিশুর মধ্যে যেমন সৌন্দর্য্য আছে, তেমনি বৃদ্ধ অবস্থারও একটা সৌন্দর্য্য আছে। চুল পাকলে পাকুক। তাতে কলপ করে রঙ মাখিয়ে তরুণ সাজলে কি সেই তারুণ্য ফিরে আসবে? না খুব সুন্দর লাগবে। জীবনের প্রতিটি ধাপকে মেনে নিতে হয়।

বাবাজী বলতেন, এখন বহু সংসারেই ছেলে বৌমার সঙ্গে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাবা-মার মিল থাকে না। অনেক যুবক সন্তানরা তাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে সেই সম্মান দেয় না। তাদের যে একটা ইচ্ছা আছে, সেটাও মনে রাখে না।




একটা প্রশ্ন বারবার করলে, রেগে যায়। কটূকথা শুনিয়ে দেয়। অথচ, তারা ভুলে যায়, তারা যখন ছোট ছিল, হাজারটা প্রশ্ন করে যেত বাবা-মাকে। তারা হাসিমুখে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন।

বাবা, ওটা কী?

বাবা বলতেন, ওটা একটা গরু।

ছেলে বলত, বাবা, এটা কী? বাবা বলতেন, এটা ছাগল। ছেলে আবার গরুকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করত, বাবা , এটা কী? বাবা রাগ না করে না করে বলতেন, ওটা গরু।

আমার মনে হয়, মানুষের নানা কর্ম তাদের ভবিষ্যত ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। কেউ যদি তাদের সন্তানকে টাকা উপার্জনের একটা মেশিনে পরিণত করার শিক্ষা দিতে থাকেন, তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে খুব একটাভালো ফল আশা করা যায় কি? আমি যদি আমার বাবা-মা কে সম্মান না করি, পুত্রবধূ যদি তার সন্তানদের দাদু, ঠাকুমা সম্মান করা ভালোবাসার শিক্ষা না দিতে পারেন, তাহলে তারা কী শিক্ষা পাবে? ভবিষ্যতে কি তারা সেই শিক্ষাটাইফেরত দেবে না? 




আসলে, কেউ যদি আশা করে যে কোন কাজ করেন, তাহলে, ভবিষ্যতে আশাহত হওয়ার একটা ব্যাপার থাকে, আর সেটাই বয়ে আনে দুঃখকে। সন্তান মানুষের মধ্যে কোন আশা রাখতে নেই, পিতা-মাতার কর্তব্য তাদের মানুষ করা। ভবিষ্যতের ইনভেস্টমেন্টহিসাবে মানুষ করলেই বিপদ। সেই আশা পূরণ না হলেই, আসে অশান্তি। সবাই এক নয় জানি, তবে, যে মানুষ ফলের আশা না রেখে কর্ম করেন, তার জীবনে অশান্তি খুব কম। কেননা, তার কোন চাওয়া থাকে না। বাবাজী বলতেন, এই সংসারে ৪ ধরণের ভক্ত আছে। যেমন, কেউ বিপদে পড়ে ডাকে। তারা হলেন আর্ত ভক্ত। কেউ অর্থের জন্য ডাকে, তারা অর্থাথি। আর আছেন জিজ্ঞাসু ভক্ত, যিনি জানতে চান আর শেষ ভক্ত হলেন যিনি ভগবানকে জানতে চান আর তার কাছে থাকতে চান। 

 

 



এটাই জীবন। আর এই জীবনকে চিনে নেওয়ার কথা দাদাজী মহারাজ যেমন বলে গেছেন, বাবাজী মহারাজও বলেছেন। তাই বাবাজী বলতেন, এতটা পথ যখন, সাধন করলি, জীবনের বাকি দিনগুলো করে যা, কী হবে, ছেড়ে দিয়ে? রাত তো শেষ হবার পথে।

বাবাজী বুঝেছিলেন, আমাদের কর্ম, আমাদের পরবর্তী জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কর্মের ফল কিন্তু অলক্ষ্যে বয়ে যায় কর্তার সঙ্গে। তাকে দেখা যায় না, কিন্তু সময়ে সে নিজেই দেখা দেয়। তাই বাবা বলতেন, প্রতিটি কাজকে ঈশ্বরের সেবা মনে কর, তোর আর পতনের ভয় থাকবে না। ঈশ্বর তোকে দেখছেন – এটা মনে রেখে কাজ কর, দেখবি তুই আর পাপ কাজ করতে পারবি না।

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad