জীবনের ওই ‘নানা রঙ’ এর মধ্যে ধর্মও তখন আমাদের কাছেও আরেকটা ‘রঙ’ মাত্র। তাই একটু ধর্ম করার জন্য ছুটে যাই আশ্রমে। ধোপদুরস্ত বেশ পড়ে দিনকয়েক একটু পিকনিকের ঢং এ ধর্ম পালন করে নিই।
তারক ঘোষ
অনেক কিছুই লেখার আছে। অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু আর বলতে ইচ্ছা করেনা। কারণ, যারা জেগে ঘুমান, তাদের ঘুম ভাঙ্গানো কখনই সম্ভব নয়। আর যাদের ‘নিজস্ব একটা বিশ্বাস’ আছে, তাদের সেই বিশ্বাসকে ভাঙ্গা যায় না - ভাঙ্গতে যাওয়াটাও ঠিক নয়।
তবু, আমি মনে করি, বাবাও বুঝে গিয়েছিলেন, সব মানুষের মনের পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। লোভ আর কামনা সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। ভালো আর মন্দের পার্থক্যকে গুলিয়ে দেয়। লোভ আর কামনার কাছে যারা জীবন উৎসর্গ করে বসে আছেন, তাদের সাময়িক হয়তো বোঝানো যায়, কিন্তু তাদের সেই ‘বোঝা’ ক্ষণিকের জন্য।
এজন্যই বাবা বলতেন – “ভবী ভোলবার নয়।“
একদিন বসে আছি পুরানো মন্দিরের দাওয়ায়। এক ভদ্রমহিলা এসে প্রণাম-ট্রণাম সেরে কিছুক্ষণ ধর্মের কথা শুনে পেড়ে বসলেন, সেই একঘেয়ে সংসারের দুঃখ-কষ্টের কথা।
বাবা বললেন, আপনাকে তো বলে দিয়েছিলাম, কীভাবে চলতে হবে। সেসব মেনে চলেন?
ভদ্রমহিলা মাথা নীচু করে রইলেন।
বাবা আস্তে করে বললেন – “ভবী ভোলবার নয়।“
আসলে, মানুষের মন এমন একটা বিষয়, তার সন্ধান বিজ্ঞানীদেরও নাগালের বাইরে। মনের আসল স্বরূপ, যিনি সেই মনের মালিক, তিনিও বুঝতে পারেন না। এইখানে একটা কথা ভুল বললাম। ‘মনের মালিক’ এই শ্রেণীর মানুষেরা হতে পারেন না।
কারণ, এরা মনের কাছে দাসখৎ লিখে দিয়ে বসে আছেন। এখন মনই এদের চালায় মানে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ যেদিন নিজের মনকে নিজে চালনা করতে পারবে, ভালোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, সেই দিন তিনি তার মনের প্রকৃত মালিক হবেন, তার মুক্তি ঘটবে।
বহু মানুষ চান না মুক্তি। সংসারের ভালো-মন্দে মিশে কাটাতে চান জীবন।
আচমকাই এদের মনে হয়, একটু সাধু-সঙ্গ করা যাক, নইলে।।
‘নইলে’ কিছুই হবে না। আপনি সাধু-সঙ্গ করেও যা পাবেন, না করেও তাই পাবেন – যদি মন আপনার বশে না থাকে। মনের ভিতর অর্থ-কামনা রেখে বাইরে হরি-সংকীর্তন করলেও কিছু হয় না। তখন না ঘরকা, না ঘাটকা – ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকতে হবে।
অনেক মানুষ আছেন, যারা এইভাবে ঝুলে থাকতেই ভালোবাসেন। একদিকে, বাড়িতে স্ত্রী, অন্যদিকে বাইরে মহিলা সংসর্গ। কীভাবে সামলাতে হয়, এরাই জানেন।
একশ্রেণির মানুষ আছেন, যাদের মনে হয়, ধর্ম আর জীবন একটু আলাদা। যেমন জীবন চলছে সেইভাবে চালাতে চালাতে, উপরে একটু ধর্মের প্রলেপ লাগিয়া যাওয়া। আমার মনে হয়, সাইকেলের ফাটা টায়ারও রিসোলিং করে বেশিদিন চলতে পারে না।
জীবনকে ধর্ম ধারণ করার মতো গড়ে না তুলতে পারলে থিয়েটারের কুশীলব হয়েই থাকতে হবে। স্টেজেরর উপর শুধু শোনা কথা বলে যাওয়া- উপলব্ধির দরকার নেই।
বাবাজী মহারাজ তার ‘গৃহস্থ জীবনে ভগবদ সাধনা’ প্রবন্ধে লিখছেন – “ একটি সু-সন্তানের মা হওয়া খুব কঠিন কাজ। সংযত চিত্ত না হলে সদ্গৃহস্থ হওয়া যায় না। সন্তান উৎপন্ন করা একটা বিরাট দায়িত্বের কাজ। এটা সস্তা আমোদের নয়। যে ছেলে (পুরুষ) যেখানে সেখানে যে কোন নারীতে বীর্য নিক্ষেপ করে দেয় তাকে পাপাত্মাস্বেচ্ছাচারী বলা হয়েছে। এই অশুভ বীজ কোন শুদ্ধ যোনিযুক্ত স্ত্রীর যোগ্য নয়। তার স্পর্শে শুদ্ধ যোনিও অশুদ্ধ হয়ে যায়।“
“যো যত্র তত্র বা রেতঃ সিক্তা শূদ্রাসু বা চরেত।
কামচারী য পাপাত্মা বীজং তস্যাশুভং ভবেত।।“
বাবাজী সোজা কথা সোজা ভাবে বলতেন। ধর্মের জটিল ব্যাখ্যা দিতেন আধুনিক জীবনের উপমা টেনে। সবাই যখন তার কাছে বসে, এসব শুনতেন, মনেই হতো না, আমরা মনে এক আর বাইরে আর এক। মনকে সাময়িক ধর্মের কাছে ব্নধক রাখতেই ভালোবাসি। সমস্ত জীবনটা নয়। জীবনের নানা রঙ, যদি গায়ে না মাখতেই পারলাম, তাহলে জীবন কীসের জন্য! একবারইতো জন্মাবো। তাই চেটেপুটে ভোগ করে নাও জীবন। জীবনের ওই ‘নানা রঙ’ এর মধ্যে ধর্মও তখন আমাদের কাছেও আরেকটা ‘রঙ’ মাত্র। তা
ই একটু ধর্ম করার জন্য ছুটে যাই আশ্রমে। ধোপদুরস্ত বেশ পড়ে দিনকয়েক একটু পিকনিকের ঢং এ ধর্ম পালন করে নিই।
বাবা এই ধরণের ভাবনাকেই বলেছেন, ভবী ভুলবার নয়। তাই সংসারী মানুষদের বারে বারে সাবধান করেছেন। নানাভাবে, নানা উদাহরণের সাহায্যে। আর সাধু শিষ্যদের তো অহরহই বলে গেছেন, কীভাবে তারা চলবেন। ভগবানের সাধনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে প্রমান করতে হয়, তিনি কেমন সাধু। ন
ইলে ভক্ত যদি দেখেন কোন এক সাধুর সঙ্গে তার অমিলের চেয়ে মিলটাই বেশি, দুদিন পর তিনি আর সেই সাধুকে তার প্রাপ্য সম্মান দেবেন না, বা দেওয়ার কথাও ভাববেন না।
বাবাজী মহারাজ লিখছেন – “আপাত প্রলোভনের মধ্যে পড়ে খারাপ কাজ করতে নেই। সংসারে লোভ প্রলোভন জড়িয়ে আছে। এরা সব হাতছানি দিয়ে মানুষকে অধর্মের পথে টানতে থাকে। প্রথমে বেশ ভালো লাগবে। এমনকি লাভও হবে। তারপর অধর্ম জীবনে তার বিষদাঁত বসাতে শুরু করে। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।“
একটা সময় দেখলাম, বাবাজীর মধ্যে চিন্তার এক কুয়াশা। সেই কুয়াশা তাকে ঘিরে রাখতো। কীসের সেই চিন্তা, কেন এই চিন্তা। যারা আমার কথাকে মনে করবেন, প্রলাপ বকছি, তারা একটু দয়া করে ফিরে যাবেন অতীতে।
২০১১-১২ সালের পর থেকে মনে করার চেষ্টা করুন, বাবার সামগ্রিক রূপ।
আর আমার দুর্ভাগ্য, আমাদের শুনতে হয়েছিল বাবার শেষ টেলিফোনে কথা –“সময়টা খারাপ।“
চলবে...