গুরু হিসাবে নয়, স্বামী জানকীদাসজী মহারাজের শিষ্য হিসাবেই সব কর্ম করে গেছেন স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী মহারাজ

বাবাজী মহারাজের প্রতিটি কর্ম, উপদেশ সবকিছুর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন হয়েছিলেন স্বামী জানকীদাসজী মহারাজ। নিজের আলাদা অস্তিত্বকে তুলে না ধরে গুরুদেবের ভক্ত-শিষ্য হয়েই সমস্ত কাজ করে গেছেন এই গুরু-অন্তপ্রাণ সাধক
তারক ঘোষ

 বাবাজী মহারাজের প্রতিটি কর্ম, উপদেশ সবকিছুর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন হয়েছিলেন স্বামী জানকীদাসজী মহারাজ। নিজের আলাদা অস্তিত্বকে তুলে না ধরে গুরুদেবের ভক্ত-শিষ্য হয়েই সমস্ত কাজ করে গেছেন এই গুরু-অন্তপ্রাণ সাধক। যেখানে যা কিছু করেছেন, সেখানেই তিনি দিয়ে গেছেন গুরু-দক্ষিণা। তার প্রতিষ্ঠিত আশ্রম, বিদ্যালয় আজ ও ভবিষ্যতে বয়ে নিয়ে যাবে তার শ্রীগুরুদেবের নাম।
 নিজের নয়, সারাটা জীবন তিনি করে গেছেন গুরু-বন্দনা। 
দাদাজী মহারাজের দেখানো পথেই তিনি পা রেখেছেন, তার দেওয়া শিক্ষার আলোয় তিনি জগতকে দেখেছেন, তার দেওয়া উপদেশ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রদেশে প্রদেশে। 
তিনি ছিলেন এক অন্তর-সন্ন্যাসী। আর তিনি অন্তরে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন সেই ছোট্ট অবস্থাতেই। আর সেখানেও ছিল দাদাজী মহারাজের বলে যাওয়া কয়েকটি অতি মূল্যবান কথা। 
বাবাজীর একটা প্রশ্নের উত্তরে দাদাজী বলেছিলেন- “দেখ শ্মশান আর সন্ন্যাস সমান জ্ঞান করতে হয়। আসক্তিশূন্য হয়ে জীবন্মৃত না হতে পারলে কেউ সাধু হতে পারেন না।“
এই কথাটা সেদিন তার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল, আমাদের মতো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেননি। শুরু হয়েছিল তার অন্তরের বৈরাগ্য সাধনা। 
এ যে কতো কঠিন এক ব্রত- যারা পালন করতে পেরেছেন, তারাই জানেন। বাবাজীকে দাদাজী মহারাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সংসার বাইরে থাকে না, থাকে মানুষের মনে। চিন্তাটাই আসলে সংসার। আমরা বাবাজীর মুখে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম –“Danger always comes from the within never from outside.” এই কথাটা বাবাজীকে বলে গিয়েছিলেন তার শ্রীগুরু। 
আজীবন সেই বাক্যকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসাবে অন্তরে-বাহিরে বয়ে নিয়ে গেছেন এই সাধক। আমাদেরও বলেছেন। আমরা পালন করিনি, কিংবা বুঝিনি। শিষ্য যে কতটা গুরু-অন্তপ্রাণ হতে পারে, আমরা যদি তার প্রতিটি কথা আর একবার ভাবি বুঝতে পারব। 


দাদাজী মহারাজের আধ্যাত্মিকতা ও জীবন দর্শন বারে বারে প্রতিফলিত হয়েছে শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাসের চলার প্রতিটি পদক্ষেপে। নিজের আলাদা অস্তিত্ব না রেখে, নিজে গুরুদেব হিসাবে শিষ্য-সমাজে পরিচিত হওয়ার পরও তার মধ্যে ‘গুরুভাব’ নয়, ‘শিষ্যভাব’ ই প্রকট হয়েছিল, তার প্রবচনে, তার কর্মে, তার চিন্তায় ও চেতনায়।
আমরা যেমন বয়স বাড়লেও মা-বাবার কাছে, সেই আদরের ছোট্ট ছেলে বা মেয়ে হয়েই থাকি, বাবাজী মহারাজও সেই শিষ্য হিসাবেই থেকে গেছেন। কোনদিন তিনি কাউকে বলেন নি –“আমি আশীর্বাদ করছি…আচ্ছা, আমি দেখছি … তিনি আমিত্বের খোলস ছেড়ে দিয়েছিলেন বহুদিন আগেই, লীন হয়ে গিয়েছিলেন গুরুরূপী ঈশ্বরের মনে। 
তাই বলতেন – আমি তোর কথা শ্রীগুরু আর ভগবানকে নিবেদন করব। আমরা বাবার মুখে রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতার উদ্ধৃতি শুনেছি। 
তার মধ্যে একটা ছিল –“আছ তুমি হৃদয় মাঝে একথা কবে সহজ হবে।“ 
দাদাজী মহারাজের বলে যাওয়া গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাংশ, যেন তার চেতনায় মিশে গিয়েছিল। এই ছোট্ট বাক্যের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক দর্শন। 
তিনি যে হৃদয়েই থাকেন, এই কথাটা আজও আমরা বুঝি নি। বুঝলে, অন্যায় করার আগে আমরা ভাবতাম, তিনি কিন্তু আমাদের হৃদয়ে বসেই সব লক্ষ্য করছেন। কারণ - –“আছ তুমি হৃদয় মাঝে একথা কবে সহজ হবে।“
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বাবাজী মহারাজ লিখেছেন তার শ্রীগুরু সম্পর্কে। আমি অংশটি শুধুমাত্র চলিত বাংলায় লিখছি।
 “শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজকে একবার একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে পাপ পূণ্যের মধ্যে কাটাকাটি হয় কিনা। কেউ ঘুষ খেয়ে অসৎভাবে টাকা উপার্জন করে সাধুর আশ্রমে ভান্ডারার জন্য টাকা দান করেন, পাপখণ্ডনের আশায়। এতে কি সত্য সত্যই পাপের খণ্ডন হয়? শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ এর উত্তরে বললেন – ‘না, পাপ-পূণ্যের এইভাবে কাটাকাটি হয় না। পাপের ফল ও পূণ্যের ফল আলাদা আলাদাভাবে ভোগ করতে হয়। পূণ্যের দ্বারা পাপের ফল কাটা যায় না।“ 
দাদাজীর বলে যাওয়া শান্তিপথের সন্ধান করতে জীবনভর তিনি কর্মের সাধনাই করেছেন। ধর্ম যে কর্ম ব্যতিরেকে হয় না, তিনি সেটা বুঝেছিলেন। আর আমাদেরও বোঝাবার চেষ্টা করে গেছেন।
একটা সত্য কি জানেন? আমরা যদি বাবাজীর বলে যাওয়া কথা আর একবার শুনি, আমরা দেখতে পাব দুঃখের উৎপত্তি কোথায় আর কীভাবে তার নিবৃত্তি সম্ভব। 
সাধনা শুধু সাধু জীবনের অঙ্গ নয়, গৃহী জীবনে ভাল থাকার চাবিকাঠি। বাবাজী সেই চাবিকাঠি আমাদের প্রত্যেককে দিয়ে গেছেন। বোকা আমরা, চাবি নিয়েই সন্তুষ্ট। বাক্সটা যে পড়ে আছে, সেটা খুলে দেখা প্রয়োজন, এটাই ভুলে গেছি। 
কীভাবে গুরুবাক্য পালন করতে হয়, সে প্রসঙ্গে বাবাজী বলছেন – “গুরু যা আদেশ করেন, তা নির্বিচারে পালন করতে হয়। গুরু যদি পূর্ব দিককে পশ্চিম বলেন, শিষ্যকে তাই বলতে হয়। এতে জ্ঞান-বিচারের অভিমান থেকে শিষ্যরা মুক্ত হন। গুরুর কাছে শিষ্যের কোন প্রতিজ্ঞার মূল্য থাকে না।“ বাবাজীর কথায় – আত্মদান না করলে, গুরু লাভ হয় না। আত্মা লাভ হয় না।“ 
আমরা পারিনি গুরু-চরণে লীন হতে, বাবাজী পেরেছেন, তাই আজও তিনি পড়ে আছেন তার শ্রীগুরুর চরণে, তার শিষ্য হয়েই।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad