সম্প্রতি, গ্রেপ্তার হয়েছেন যুব তৃণমূলের দুই নেতা কুন্তল ঘোষ ও শান্তনু ব্যানার্জী। এদের মধ্যে শান্তনু ব্যানার্জী আবার হগলির তারকেশ্বর থেকে নির্বাচিত হুগলি জেলা পরিষদের এক কর্মাধ্যক্ষ। অবশ্য গতকাল, দল এদের বহিষ্কার করেছে।
গতকাল ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বীরভূমের অবিসংবাদিত তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের হিসাব রক্ষক। অন্যদিকে, ডিএ এর দাবিতে সরকারী কর্মীদের একাংশের অনশন আন্দোলন, স্কুলে চাকরির দাবিতে ভাবী শিক্ষকদের ২ বছর ব্যাপী আন্দোলন।
এর উপর আছে এসএসসি দূর্নীতিতে অভিযুক্ত হাজার হাজার বেআইনি শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি যাওয়ার ঘটনা, টাকার বিনিময়ে স্কুলে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ, কলকাতা সহ একাধিক জায়গা থেকে বেআইনি অর্থ ও সম্পত্তি উদ্ধার, কয়লা ও গোরু পাচার সংক্রান্ত নানা অভিযোগ ও তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রিয় এজেন্সিদের তদন্ত।
এতরকম ঘটনার মাঝেই, সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংরেস প্রার্থীর জয়, সংখ্যালঘু ভোটের একটা বিরাট অংশ তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীকে যে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ দেখছেন না রাজনৈতিক মহল।
কিন্তু, এত কিছুর উর্ধে রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীকে ভাবাচ্ছে সংখ্যালঘু ভোট। তৃণমূল নেত্রী বা দলের বড়, মাঝারি, ছোট নেতারা এ নিয়ে মুখে কিছু না বললেও, দলনেত্রীর সাগরদিঘী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দলের অভ্যন্তরে তদন্তের নির্দেশ, ফুরফুরা শরিফ বোর্ড থেকে ফিরহাদ হাকিমকে সরিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও জেলার দাপুটে তৃণমূল নেতা তপন দাশগুপ্তকে চেয়ারম্যান করা, নিঃসন্দেহে এই নিয়ে ভাবনার এক প্রতিফলন।
অন্যদিকে আইএসএফ বিধায়ক নৌসাদ সিদ্দিকির দিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশের আবেগ দলকে নিঃসন্দেহে ভাবাচ্ছে। আর এই সব ভাবনা থেকেই ফুরফুরা শরিফের সাহেবদের মন জয় করার চেষ্টা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।
কারণ, সংখ্যালঘু ভোটের একটা বিরাট অংশ যদি বাম-কংগ্রেস জোটের দিকে ধলে পড়ে, তাহলে, তৃণমূলের পক্ষে বহু পঞ্চায়েতে হার কিংবা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, বিজেপি এককভাবে লড়লেও সংখ্যালঘু ভোটকে তারা ভোটবাক্সে ধরতে পারবে না বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহল মহল।
এইরকম এক পরিস্থিতিতে খোদ দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে দাঁড়াতে হচ্ছে যাদের অযোগ্য প্রমানিত হওয়ায়্ চাকরি গেছে তাদের পাশে। বিরোধীদের এটাই বক্তব্য।
আর এখানেই কিছুটা রাজনৈতিক ফায়দা দেখতে পাচ্ছে বিরোধীরা। গতকাল মমতা ব্যানার্জী যেভাবে অযোগ্য শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন, তাকে, রাজনৈতিক ‘হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে বিরোধীরা।
ভোট ময়দানে, তারা বলতে চলেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগ্যদের পাশে না দাঁড়িয়ে অযোগ্যদের পাশে যেভাবে দাঁড়াচ্ছেন, তাতে কী স্বার্থ জড়িত আছে নেত্রীর! এই প্রশ্ন ইতিমধ্যে তুলেছেন বিরোধী নেতা-নেত্রীরা।
এখন প্রশ্ন হলো, এত বিরুদ্ধ পরিবেশে তৃণমূল কি আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ধরে রাখতে পারবে? হাতে হাজার ‘হাতিয়ার’ পেয়ে বাম-কংরেস কিংবা বিজেপি কি ভোটে ফয়দা তুলতে পারবে?
উত্তর অনেক, যার এক বিরাট অংশে আছে নানা সম্ভাবনা, পাটিগণিতের হিসেব আর সবার উপরে জনতার রায়।
জনগণের দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে, মুখ্যমন্ত্রীর নানাবিধ সামাজিক প্রকল্পে উপকৃত রাজ্যের কয়েক কোটি মানুষ। এই প্রকল্পের মধ্যে আছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প। আবার, লক্ষীর ভান্ডার বা কৃষক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নানা প্রকল্প।
এগুলো যদি দাঁড়িপাল্লার একদিকে চাপানো হয়, আর অন্যদিকে দূর্নীতির অভিযোগ আর বিরোধীদের, তাহলে ফল কী দাঁড়াবে। এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে জনতার মনে। আর এর উত্তর পেলেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে, কে জিতবে।
দেখা যাচ্ছে, ডিএ কে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, তার ফল সমাজের একটা ছোট অংশে পড়তে পারে। কেননা, রাজ্যের নাগরিকদের খুব ছোট্ট অংশ এই সরকারী কর্মচারী। বহু মানুষ বলেছেন, তাদের খুব একটা মাথা-ব্যাথা নেই এসব নিয়ে।
কিন্তু, এসএসসি নিয়ে যে অভিযোগ, চাকরি যাওয়া, বা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার যে অভিযোগ, বা যোগ্যদের বঞ্চিত করার অভিযোগ, তার একটা সূদূর-প্রসারী ফল আছে।
কেননা, এই সমস্ত চাকরি যাওয়া, বা যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ, তাদের একটা বিরাট অংশ গ্রাম-পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা।
ফলে, উভয় পক্ষের পরিবার কিংবা গ্রামের সাধারণ মানুষদের বিরোধীদের দিকে ঢলে পড়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। অবশ্য সেটা কীভাবে বিরোধীরা কাজে লাগাবেন বা রাজ্যের শাসক দল কীভাবে সেই ঘায়ে মলম লাগাবেন, তার উপর নির্ভর করছে ফলাফল।
অন্যদিকে, সাধারণ মানুষদের একটা বড় অংশ, নানা দূর্নীতির অভিযোগ শুনতে শুনতে ভাবছেন, তাহলে পরিবর্তনের ফল কী হলো?
আগের সরকার যদি চাকরি চুরি করে, আর এই সরকারও যদি সেদিকে পা বাড়ায়, তাহলে বাম আর তৃণমূলে তফাত রইলো কোথায়? তারা কী কারণে সরকারের বদল করলেন!
ফলে, সব মিলিয়ে গ্রামের সাধারণ ভোটাররা বিভ্রান্ত। দলীয় সমর্থকরা অবশ্য নিশ্চিত তাদের ভোট-ব্যাঙ্ক নিয়ে। কিন্তু, শতকরার হিসাবে সংখ্যালঘু ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে।
যদি, বিরোধীরা পঞ্চায়েতে লড়াই করার জন্য প্রার্থী দিতে পারে (প্রার্থী না দিতে পারার অভিযোগ বিরোধীদের), তাহলে এই সংখ্যালঘু ভোট আর এসএসসি দূর্নীতির অভিযোগ তৃণমূলের বিপক্ষে চলে যাওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা দেখছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজ্যে, কংগ্রেসের পালে হাওয়া থাকুক, বা না থাকুক, বামেদের পুরানো কার্যকলাপ জনতা মনে রাখুক বা না রাখুক, ভোটের একটা অংশ যে কোন বিরোধী শক্তির কাছে কিংবা নোটাতে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন ওয়াকিবহল মহল বিশেষ করে, নতুন ভোটারদের একটা বড় অংশের ভোট নোটায় যেতে পারে।