আজ বাবাজী দেহে নেই, তাই, তিনি এখন এক আত্মা নয়, লক্ষ আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে আছেন, লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয়ে। তিনি যে তাদের উদ্ধার করার ব্রত নিয়েছেন তার শ্রীগুরুর কথায়। তাদের ফেলে কি তিনি যেতে পারেন!
আমাদের বাবাজী মহারাজ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, বিজ্ঞান-মনষ্ক এক সাধক কর্মযোগী। আর তার এই শিক্ষার অগ্রগতির পিছনে ছিল বাবাজীর ঐকান্তিক ইচ্ছা আর দাদাজী মহারাজের অনুপ্রেরণা। দাদাজী মহারাজ বুঝেছিলেন, আধুনিক সময়ে শিক্ষাকে দূরে রেখে শুধু ধর্ম নিয়ে থাকলে, সাধকরা সমাজের সেভাবে কোন সংষ্কার করতে পারবেন না।
গুরুদেবরা যদি শিক্ষিত না হতে পারেন, তাহলে তারা ভক্তদের জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতেও পারবেন না। কারণ, বর্তমান সমাজে ঘরে ঘরে এমএ, এমএসসি। তাদের বিশ্বাস করাতে হলে, তাদের বোঝাতে হলে গুরুকেও সেই উচ্চতায় উঠতে হবে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন এক ব্যতিক্রমী যুগপুরুষ। তার লোকশিক্ষা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখাচ্ছে, অবশ্য সেই ব্যক্তিরা যদি সৎ-পথের পথিক হতে চান।
আর স্বামী জানকীদাসজী ছিলেন আর এক যুগপুরুষ। তার শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাসজী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের পথের পথিক। তার জীবনে পড়েছিল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী আর তার বাবাজী মহারাজ স্বামী জানকীদাসজীর ছায়া।
আমরা জানতে পারছি, গুরু-পরম্পরা যাতে সঠিক পথে যেতে পারে, সেজন্য স্বামী জানকীদাসজী তার প্রিয় শিষ্য স্বামী প্রজ্ঞাদাসজীকে লেখাপড়া শিখিয়ে মনের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং তা পেরেছিলেন।
স্বামী জানকীদাসজী তাই বাবাজী মহারাজকে বলতেন, “দেখ, তোকে যে এত লেখাপড়া শেখাচ্ছি, সেটা কিন্তু তোর নিজের জন্য নয়। তোর গুরুভাই এবং আগামি দিনের ভক্ত-শিষ্যদের সৎ পথে পরিচালিত করার জন্য। তাদের ভার তোকেই বহন করতে হবে। তোকে অনেক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।“
বুঝতে পারছেন পাঠকগণ, বাবাজী কেন উচ্চশিক্ষিত ডক্টরেট হয়েও, সেই শিক্ষাকে নিজের উন্নতি জন্য কাজে লাগান নি?
অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, “বাবাজী মহারাজ তো অনায়াসেই অধ্যাপক হতে পারতেন, তারপর লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে শান্তিতে থাকতে পারতেন, করেন নি কেন?”
আশা করি তারা তাদের উত্তর পেয়ে গেছেন। বাবাজী এসেছিলেন, ভুল-পথে চালিত মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। যারা তার কথা মেনে চলেছেন, তারা সেই শান্তিপথের সন্ধান পেয়ে গেছেন। যারা শোনেন নি, তারা অশান্তির আগুনে নিত্য পুড়ছেন।
আজ বাবাজী দেহে নেই, কিন্তু, তিনি এখন এক আত্মা নয়, লক্ষ আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে আছেন, লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয়ে। তিনি যে তাদের উদ্ধার করার ব্রত নিয়েছেন তার শ্রীগুরুর কথায়। তাদের ফেলে কি তিনি যেতে পারেন!
দাদাজী মহারাজ বাবাজীকে শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী শোনাতেন –
“আমবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্য হমোজসা।“
বাংলায় যার অর্থ হয় – এই পৃথিবী অতি কঠিন এক জায়গা, এখানে দুর্বলের কোন স্থান নেই। দাদাজী মহারাজ তাই বলতেন, “তোর আগামি দিনের লক্ষ্য হবে আত্মিকভাবে দুর্বল মানুষকে শক্তি যোগানো। রক্ষা করতে হবে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ধারা।
গুরু-অন্তপ্রাণ সাধক ছিলেন আমাদের বাবাজী মহারাজ। এই জন্মটা তিনি দান করে গেছেন শ্রীগুরুকেই। তাই আমরা দেখতে পাই, তার প্রতিটি কথা, আচরণ, পথ-চলা, আধ্যাত্মিক জীবন সব কিছুতেই তার শ্রীগুরুর প্রতিচ্ছবি।
এই ধরণের শিষ্য ভারতের আধ্যাত্মিক জগতে খুব একট সুলভ নয়।
আঘাত তার জীবনে বারবার এসেছে আশীর্বাদের রূপে।
কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন – ঈশ্বর যা করেন, তা সকলের মঙ্গলের জন্যই করেন। তাই গুরুবাক্য হৃদয়ে ধারণ করে ছেড়ে এসেছিলেন বড়র আশ্রম। তিনি বুঝেছিলেন, তার জীবনে থামা নেই, তার জীবনে বিশ্রাম নেই – আছে শুধু পথচলা। এগিয়ে চল, এগিয়ে চল, চরৈবেতি! চরৈবেতি!
এই বাক্য সম্বল করেই তার পথচলা। লক্ষ্য মানুষকে সঠিক পথ দেখানো। তাই যেখানেই গেছেন, সেখানেই প্রবচন দিয়েছেন। যাকেই শিষ্য করেছেন, তাকেই নানাভাবে আগলে রেখেছেন।
যারা ভুল করেছেন, তাদের শাস্তি দিয়েও আবার কোলে টেনে নিয়েছেন। কারণ, তিনি তো মহাশিক্ষক। ‘ছাত্র’ ভুল করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই না? আর তার পরেই আসে কবিগুরুর সেই অমোঘ বাণী-
“দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে,
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।“
তিনি বারবার সাধু শিষ্যদের সাবধান করেছেন । বিষয়ের সঙ্গে যোগ না রাখতে, লোভ ত্যাগ করতে, অর্থের পিছনে না ছুটতে। যারা সেই গুরুবাক্য অমান্য করেছেন, তাদের জীবনে নেমে এসেছে অচিন্তিত আঘাত।
জানি, সেই আঘাত দিয়েই শিষ্যকে তিনি সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। শুধু অপেক্ষা করতে হবে, কবে তারা তাদের ভুল বুঝে অনুশোচনার আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করবেন।
বাবাজী তাই বলতেন, চাওয়ার সীমা অন্তহীন, তাই তাকে পাওয়ার মাধ্যমে নিবৃত্ত করা যায় না।
চাওয়া যদি বাস্তব সম্মতও হয়, তবু, সেখানে একটা সীমারেখা টানা প্রয়োজন, নইলে একসময় মানসিক আঘাত তাকে প্রতিমুহুর্তে কুড়ে কুড়ে খাবে।