বাবাজী মহারাজ যখন বলতেন – আমি বকাউল্লা, বকেই যাচ্ছি… অনেকেই এটাকে হাসির উপদান হিসাবে দেখে হেসে উঠতেন। ভাবতেন, বাবাজী মজা করছেন। কেউ দেখার চেষ্টা করেন নি, এই কথা গুলোর মধ্যে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। সেই যন্ত্রণাকে ক’জন খুঁজতে চেয়েছে!
শ্রীবাবাজী মহারাজের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় পুরুষদের একটা বিরাট পার্থক্য ছিল, সেটা হয়তো অনেকের চোখে পড়েনি, কিংবা বাবাজী মহারাজের সেই বিশেষ দিকটিকে ভক্তরা সেভাবে গুরুত্ব দেন নি। আর সে জন্যই বাবাজী মহারাজের কাছে সেই ধরণের প্রশ্ন ভক্তরা করে উঠতে পারেন নি। বাবাজীর কাছে দার্শনিক প্রশ্ন তুলে ধরার চেয়ে, তার কাছে মন্ত্র-দীক্ষা নেওয়া, উপনয়ন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন – এইগুলি নিয়েই খুশি থাকতেন ভক্তরা। একজন সন্ন্যাসীর কাছে সাংসারিক দুঃখ-অশান্তি-বিবাহ-চাকরি – এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই বেশিরভাগ ভক্তরা আসতেন।
ফলে, তাকে আলাদাভাবে চিনে নেওয়ার বা তার প্রচেষ্টা একেবারেই ছিল না বললেই হয়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে – মুড়ি-মুড়কির এক দর – এটাই হয়েছিল। তিনি একজন সমাজ গবেষক, দার্শনিক ও বিজ্ঞান-মনষ্ক ‘স্পিরিচুয়াল সায়েন্টিস্ট’ ছিলেন, এটা অনেকেই ভাবতে পারেন নি, বা ভাবতে চান নি।
তাই, বাবা কী জন্য এই সংসারে এসেছিলেন, কী করছিলেন, কী করতে চেয়েছিলেন বা আরো কী করতে পারতেন – সেই দিকটাই প্রায় অনালোকিত থেকে গেছে। তাকে কেউ ধর্মের আলোতে এনেছেন, কেউ গুরুদেব হিসাবে দেখেছেন, কেউ বা একজন সাধু হিসাবে ভেবেছেন।
তার বাহ্যিক জটা-দাড়ি-শুভ্র বসনের আড়ালে যে অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী একজন ‘সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা বিচক্ষণ সমাজ-সংষ্কারক’ লুকিয়ে ছিলেন, সেটা ভালোভাবে দেখানো হয় নি। অনেকে তার আশ্রম বিস্তার এর দিকটা তুলে ধরেছেন। কেউ সেটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, কেউ দেখানোর চেষ্টা করেছেন মহন্তাই এর জন্য তিনি কতটা ‘উদগ্রীব’ ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ এটা বলেন নি – তিনি কি সত্যি চাইতেন আশ্রমের বিস্তার, তিনি কি সত্যি চাইতেন, আশ্রমে অর্থের অনুপ্রবেশ হোক, তিনি কি সত্যি চাইতেন, ব্ল্যাক মানি কিংবা অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাকে কেউ উপঢৌকন দিক। চাইতেন না। একেবারেই চাইতেন না।
তাই বারে বারে বলেছেন – আমি কীজন্য এসেছি, কেউ জানতে চাইল না।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বাবাজী মহারাজকে একটি গীতা ও কলম দেবার। অর্থ দিতে পারিনি, সামর্থ্য ছিল না বলে নয়, ভাবতে পারি নি বলে। কারণ, সন্ন্যাসীরা অর্থের নাগপাশ থেকে মুক্ত থাকেন। এটাই আমার শিক্ষা ছিল। আর যে সন্ন্যাসী অর্থের দাসত্ব করেন না, অর্থের অভাবে তার কোনো কাজই থেমে থাকে না। এটা স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
যেটা বলছিলাম – বাবা সেদিন বুকে করে সেই গীতা আর কলম নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন। সেদিন তার পায়ের কাছে প্রণামী হিসাবে পড়েছিল বহু নোট। সেটা তিনি স্পর্শ করেন নি। বুঝেছিলাম, তিনি কী চান। এর মানে এই নয়, যে ভক্তরা বাবাকে প্রণামী দিয়েছিলেন, তাদের তিনি অন্যভাবে দেখেন। একেবারেই নয়।
তিনি সব ভক্তদের ভালোবাসতেন, নাম জানতেন, কীভাবে তারা কষ্ট করে আশ্রমে আসেন, তার খোঁজ রাখতেন। কে প্রসাদ পান নি, সেদিকেও ছিল তার পিতৃসুলভ দৃষ্টি।
কিন্তু, তার মন অর্থ থেকে অনেক দূরে ছিল। এই সংসারের মাঝে থেকেও তার দৃষ্টি কোন কিছুকেই স্পর্শ করতো না। শিশুর মতো হাসতেন, শিশুদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন।
“আপনি কেন এসেছেন?’ এই প্রশ্নটা কেউ বাবাজীকে জিজ্ঞাসা না করলেও সাংবাদিকরা বাবার কাছে এই প্রশ্নটাই একটু ঘুরিয়ে করেছিলেন।
তাই ওই প্রশ্নের উত্তর বাবাজী দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, তার উদ্দেশ্য কী ছিল।
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত| অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজম্যহম্ ||
বাবাজী মহারাজ কুম্ভ মেলায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন – গীতার কথাই আর একবার মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাই। আমি ভগবানকে ডাকতে, সাধন-ভজনই শুধু করতে আসি নি। আমি চাই, আমি যেটুকু জেনেছি আমার সাধনায়, অল্প শিক্ষায়, মানুষের মধ্যে তা ভাগ করে একটা সুস্থ সমাজ গড়তে। হানাহানি বন্ধ করতে। হিংসাকে জয় করতে শেখাতে। লোভকে সংবরণ করতে।
আসলে, এই কথাগুলো বলার পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল বলে মনে করতেন সাংবাদিকরা। শ্রীপ্রজ্ঞাদাসজী দেখেছিলেন একশ্রেণির ধর্মীয় মানুষদের পদ ও ক্ষমতার লোভের জন্য তার শ্রীগুরুকে পর্যন্ত অসম্মানিত হতে হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন একশ্রেণির ‘সাধু’দের হানাহানি সমাজে কতটা বিপজ্জনক প্রভাব ফেলে।
তিনি দেখেছিলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা গোপন হিংসা থেকে মুক্ত নয় সাধু সমাজের একটা অংশ। এসব তাকে ব্যথিত করত। শেষ দিকে আর তাই আশ্রমে থাকতে চাইতেন না, তার মন সমর্পিত হয়ে গিয়েছিল শ্রীগুরুর চরণে, আর হৃদয়ে ছিল শ্রীভগবান।
তাই পার্থিব সব কিছু থেকেই মন সরিয়ে নিয়েছিলেন। বিষণ্নতা ছেয়ে ফেলছিল এই অসামান্য প্রজ্ঞার অধিকারী এক আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানীকে, এক দার্শনিককে।
বাবাজী মহারাজের কর্ম জগতকে সাংবাদিকরা সম্মান করতেন, তার চিন্তাধারাকে এক আধুনিক চিন্তাধারা আখ্যা দিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। তার সমাজ-সংষ্কারের নতুন ভাবনাকে মডেল হিসাবে তুলে ধরার কথাও ভাবা হচ্ছিল। বাবাজী মহারাজ স্বামী জানকীদাসের আদর্শ আর ভাবনায় প্রতিপালিত। তিনিই বাবাজীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত।
মাস্টার্স করার পর তার গবেষণার বিষয় নির্বাচন করেই শ্রী জানকীদাসজী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাবা কোন পথে চলবেন, তার এই ধরায় আসার আসল উদ্দেশ্য কী।
বাবাজী বলেছিলেন, তার শ্রীগুরু চেয়েছিলেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা কুসংষ্কারকে খুঁজে বের করে সাধারণের কাছে তা নিবেদন করতে।
আসলে, তিনি এসেছিলেন এই সমাজের সংষ্কার করতে। পাপ, বিলাসিতায় নিমগ্ন সমাজের একটা অংশের ‘ঘুম’ ভাঙ্গাতে। আর এই সদা জাগ্রত সংষ্কারকের এই দিকটা নিয়ে ভক্তদের মধ্যেও খুব একটা আলোচনা হয় না। আর সেটাই আক্ষেপ ছিল বাবার। অনেকেই গুরুদেবকে নিছক এক গুরুদেব হিসাবেই দেখতেন।
তার বলা ধর্ম-সংষ্কার, সমাজ-সংষ্কার নিয়ে কারো খুব একটা মাথাব্যাথা ছিল বলে মনে হয় না।
যদি তাই হত, তাহলে বাবাজী বলতেন না – করিমুল্লা কেউ নেই। বাবাজী যখন বলতেন – আমি বকাউল্লা, বকেই যাচ্ছি… অনেকেই এটাকে হাসির উপদান হিসাবে দেখে হেসে উঠতেন। ভাবতেন, বাবাজী মজা করছেন।
কেউ দেখার চেষ্টা করেন নি, এই কথা গুলোর মধ্যে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। সেই যন্ত্রণাকে ক’জন খুঁজতে চেয়েছে! ক’জন, বাবার আদর্শকে মনে রেখে নিজেদের জীবনকে বদলে ফেলেছে! ক’জন বাবাজীর আলোতে এই সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে এসেছে!
বেশিরভাগ মানুষ, ভক্ত, সাধু, তাকে বেঁধে রেখেছেন ধর্মীয় গন্ডীর মধ্যে। তাকে শুধু গুরুরূপেই প্রণাম জানাচ্ছেন, কেউ ভাবেন নি, তিনি এক নতুন ভারতের রূপকার হিসাবেই এই ধরায় এসেছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন, তার শিষ্য-ভক্তরা তার ভাবনাকে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের সংসার, জীবন ও সমাজকে সুস্থ করুন।
তাই বাবাজী মিডিয়ার কাছে আবেদন করেছিলেন, তাদের সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে। বঞ্চনা, কুসংষ্কার এর দিকগুলো তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করতে।
মিডিয়া আছে বলেই আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, লোভের পরিণতি কী হতে পারে, মিডিয়া আছে বলে, এখনো একজন নির্যাতিতা বিচারের আলোয় আসতে পারে। মিডিয়া এখনো সমাজের রক্ষকের ভূমিকায় আছে। তাই একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ মিডিয়াকেই তাদের শত্রু ভাবে।
বাবাজী তাই বলেছিলেন, যার যার পেশা, সেটাকে সততার সঙ্গে পালন করে যাওয়ার কথা। এমনকি সাধুদের ভূমিকা কী হবে, সেটাও বলে গেছেন।
শ্রীগুরুদেবের ভাবনার সঙ্গী আমরা হতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তার পায়ে প্রণাম আর প্রণামী দিয়েই গুরুদক্ষিণা দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, বাবা এসব চান নি। তিনি মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন। পেরেছেন কি?
পড়ে নিন তিনি নিজের মুখে কী বলেছিলেন – "কতটা পেরেছি, তা নিয়ে সংশয় তো আছেই।"