নির্জনে সাধন-ভজন করলে সাধকের অহঙ্কার জন্মায়, আশ্রমের বিরুদ্ধ পরিবেশও নিষ্কাম কর্ম করতে শেখায়

একেবারে উলটো মনে হচ্ছে না কথাগুলো? নির্জনতাই তো সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে প্রিয়। আর সেই নির্জনতার মাঝেই তো ভগবানকে ডাকার সুবিধা বেশি, তাই না? আসলে, তা নয়। জীব আর জগতের মাঝে মিশে কর্মে লিপ্ত থেকে সাধন-ভজন করাই মোক্ষ লাভের সহায়ক হয়।
শ্রম এমন এক জায়গা, যেখানে সারা ভারত মিশে আছে। সাধু-গৃহী সব মিলিয়ে এক মহামানবের মিলনতীর্থ। কোন সাধু এসেছেন ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে, কেউ বা এসেছেন উত্তর থেকে। কেউ বা গৃহ-জীবন থেকে নির্বাসন নিয়ে আশ্রমে এসে সাধু হয়ে যান। 
আবার আশ্রমে আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা। তাদের ভাষা ভিন্ন, তাদের শ্রেণি ভিন্ন। কিন্তু, আশ্রম তাদের মিলিয়ে দেয়, গেঁথে ফেলে এক সূত্রে। আবার এর বিপরীত একটা চিত্র বহু আশ্রমে দেখা যায়। একশ্রেণির সাধু মিষ্টভাষী, তো অন্য কয়েকজন কর্কশ, রাগী। 
এমন ‘সাধু’ও আছেন, যারা সংসার জীবনের পরচর্চা, পরনিন্দা নিয়েও মেতে থাকেন। অর্থের পিছনে ছুটে চলা লোভী ‘সাধু’র সংখ্যাও কম নয়। কাজেই আশ্রম নানা ভাষা, নানা মত মিলিয়ে এক মিলনতীর্থ।
আর এই মিলনতীর্থে থেকেই লাভ করা যায় শ্রীগীতার সেই নিষ্কাম কর্মের শিক্ষা। শ্রীধনঞ্জয়দাসজী মহারাজ শ্রীজানকীদাসজীকে বলেছিলেন – ‘আশ্রমের বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে নিজেকে তৈরি করার যেমন সুযোগ, নির্জনে একাকী বাসের মধ্যে সেই সুযোগ নেই। 
নির্জনে সাধন ভজন করতে করতে সাধকের মনে প্রায়ই সাধনের অহঙ্কার জন্মায়। আর তিনি নিজেও সেটা বুঝতে পারেন না। আবার, সেই সাধক যদি জনসমাজে আসেন, অথচ বাঞ্ছিত সম্মান পান না, তখন তার মধ্যে রাগের সঞ্চার হয়। অভিমান তাকে গ্রাস করে। এইভাবে তিনি ঠকতে থাকেন। মনকে জয় করা আর তার পক্ষে সম্ভব হয় না। 
অন্যদিকে, আশ্রমের নিন্দা-অপমান সহ নানা বিরুদ্ধ পরিবেশ তাকে ভগবানের প্রিয় কর্ম করতে শেখায়, মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মান-অপমান – সবকিছু তখন সেই সাধকের কাছে একই হয়ে যায়।
শ্রীদাদাজী মহারাজ বলতেন – ‘কর্তব্যে সর্বদা নীরস হয়।‘ শ্রীদাদাজী ও শ্রীবাবাজী মহারাজ নিজেদের তুলে আনতে পেরেছিলেন সেই উচ্চতায়, যেখানে নিন্দা-অপমান তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা কেউই মান-যশের আকাঙ্খায় মহন্ত হননি। 
একজন মহন্ত হয়েছিলেন, শ্রীগুরুদেবের সন্তুষ্টির জন্য, আর অন্যজন মহন্ত হয়েছিলেন কর্তব্যের তাগিদে। আশ্রমকে এক নিয়মের মধ্যে নিয়ে যাবেন বলে। ওই গুরু-শিষ্য অর্থের মোহে কোনদিনই আটকে পড়েন নি। কারণ, তারা জানতেন, অর্থ অনর্থের মূল। অর্থকে নির্লোভভাবে সঠিক কাজে ব্যবহার না করে, নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করলে, তার ফল হয় অতি ভয়ঙ্কর।
 দাদাজী মহারাজ বা বাবাজী মহারাজ ‘বৈরাগ্য’ কে খুব গুরুত্ব দিতেন। কেউ এসে হয়তো বললেন, তার সংসারে অরুচি ধরে গেছে, ‘এবার আমাকে সাধু করে দিন’ – এসব একেবারেই পছন্দ করতেন না তারা। একবার এই প্রসঙ্গে শ্রীবাবাজী মহারাজ শ্রীজানকীদাসজীকে নিয়ে একটি সত্যি ঘটনার কথা বলেছিলেন।
 ঘটনাটি এইরকম – পরিক্রমা চলাকালীন একবার শ্রীজানকীদাসজী বসে আছেন। সকাল ৯ টা নাগাদ এক ব্যক্তি এসে তাকে বললেন – সংসার ভালো লাগছে না সাধু হবেন। 
শ্রীজানকীদাসজী হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি বাড়িতে কোন ঝগড়া হয়েছে নাকি?’ 
ওই ব্যক্তি বললেন, ‘নেহি মহারাজ, বৈরাজ লে লেগা।‘
 শ্রীজানকীদাসজী তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। ওই ব্যক্তি মহানন্দে অপেক্ষা করতে থাকেন। আজ তিনি সাধু হয়ে যাবেন। তার মন খুশিতে টলমল। 
দুপুরে ওই ব্যক্তির স্ত্রী এসে শ্রীজানকীদাসজীকে বললেন –‘মহারাজজী, ইয়ে মর্দ হিঁয়া কিঁউ বৈঠা হ্যায়?’ শ্রীজানকীদাসজী বলেন, ‘ইয়ে তো কহতা হ্যায় এ হাম সে ভেক লে কর বৈরাগী হো জায়েগা।‘
 ওই মহিলা বলেন, ‘এ বৈরাগ লে লেগা তো ইসকো বালবাচ্চাকো কৌন খিলায়েগা?’ 
শ্রীজানকীদাসজী তখন ওই ব্যক্তিকে বললেন, ‘আভি তুম ক্যা করোগে?’ 
তিনি বলেন – ‘যব আ গয়া যানা তো পড়েগা।‘ এরপর ওরা দুজনে চলে যান।
বাবাজী মহারাজ বলছেন - সাধুদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে – ‘ঘর মে হুয়া খটপট, চল বাবাজীকা মঠপর অর্থাৎ, ঘরে অশান্তি হচ্ছে, তাই চল সাধুর আশ্রমে যাই।‘ 


আর সেই আশ্রমে এসে সাধুরা যখন সেই তাকেই আশ্রমের নানাবিধ কাজ করতে বলেন, তখনই বিপদ। তিনি তখন বলবেন, আমি তো আশ্রমে এসেছি ওই কর্মের জ্বালায়, এখানেও সেই কর্ম! বুঝুন ঠেলা। কর্মের সাধনার মধ্য দিয়েই আসা যায় ঈশ্বরের পথে। 
কর্মযোগে অভ্যস্ত না হয়ে সন্ন্যাস নিলে, তা দুঃখের কারণ হয়।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad