আজ থেকে শুরু
হলো ‘অন্য বাবাজী মহারাজ’। এখানে ব্যাখ্যা করা হবে বাবাজী মহারাজের বিজ্ঞান ও
দার্শনিক চেতনা। মানুষের মঙ্গলের জন্য যে চেতনা অপরিহার্য্য।
তারক ঘোষ
চমকে উঠলেন,
তাই না? আমিও কথাগুলো শুনে বেশ ভাবনায় পড়ে
গিয়েছিলাম। বাবাজী মহারাজ কেন বললেন এই কথাগুলো। এর আগে নতুনগ্রামে বাবাজী
বলেছিলেন – ওই বিষ্ণুদাসের দিকে তাকিয়ে দেখ, আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে। এর আগে, আর
একবার ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন – আপনাদের মধ্যেও অনেক গুপ্তযোগী আছেন।
কাজেই
ওই কথাগুলো আমাকে চমকে দিয়েছিল। বাবাজী যখন বলছেন, সেই বাক্যে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়
না। নিশ্চয় এর মধ্যে কিছু না কিছু কারণ অবশ্যই আছে। আপনারা জানেন, বৈষ্ণবের সবচেয়ে
বড় গুণ হলো বিনয়। শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষাষ্টক এ বলা হয়েছে – “তৃণাদপি
সুনিচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা / অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরি।“
কিন্তু, এর মাধ্যমে সেদিন বাবা নানা তত্বের
ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কী সেই তত্বগুলি? একদিকে, একের মধ্যে বহুত্বকে নস্যাত করে
বহুর মধ্যে এক তত্ব। ব্রহ্মও সত্য, জগতও সত্য। আবার এর মধ্য দিয়েই তিনি ব্যাখ্যা
করেছিলেন সাম্য, আত্মাতত্ব ও বিশ্বভ্রাতৃত্বকে। অন্যদিকে, গৃহীরাও কীভাবে
সন্ন্যাসীর চেয়েও বড়ো হতে পারে, সেই তত্ব। আপনারা অনেকেই জানেন, বাবাজী মহারাজ
প্রায়ই বলতেন, সংসারে থেকেই একজন সদ-গৃহস্থ ভগবান লাভ করতে পারেন। এর জন্য সংসার
ত্যাগ করার প্রয়োজন থাকে না। বরঞ্চ, তিনি ও শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ বলতেন – কর্মযোগে
অপরিণত অবস্থায় কর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলে, সেই সন্ন্যাস দুঃখের কারণ হয়।
গৃহী মানুষের জীবন গড়ার জন্য, তাদের সঠিক
দিশা দেখানোর জন্য বাবাজী মহারাজের চেষ্টার অন্ত ছিল না। তিনি বলতেন – মিথ্যা বলা
বলা ভালো নয়। এক মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে, হাজারটা মিথ্যায় জড়িয়ে পড়বেন। তাই যা কিছু ঘটুক
না কেন, প্রথমেই যা সত্য, সেটা স্বীকার করে নেওয়ায় ভালো। আর একটা কথা তিনি ভক্তদের
বলতেন, সেটা হলো – পাপের কথা অন্যজনকে বলে দেওয়া ভাল, এতে পাপের নাশ হয়। ‘পাপের
কীর্তন পাপ নাশের কারণ হয়।‘
আর একটা কথা মনে রাখতে বললেন – সত্য কথা
বলার উদ্দেশ্য যদি মানুষে মানুষে বিবাদ লাগানো, মানুষের অকল্যাণ করা, সেক্ষেত্রে
চুপ থাকাই ভালো। কারণ, সত্য কথার চেয়েও ভাল হলো কল্যাণকর কথা।
যাই হোক, আবার ফিরে যাই অসমের সেই ভক্ত
সম্মেলনে। বাবাজী মহারাজ বললেন, কলিযুগে সবকিছুই উলটো হচ্ছে, যা হওয়া উচিত নয়, তাই
হচ্ছে। মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা, বিবেক। ছেলেমেয়েরা বাবা-মার কথা
শুনছে না। চারিদিকে হানাহানি। একটা অশান্তি চারিদিকে। এমনকি মনের মধ্যেও ঢুকে
পড়েছে সেই অশান্তি। এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ভগবানের শরণ নেওয়া ছাড়া গতি নাই।
বাবাজী বলেছিলেন – ভগবান আছেন আপনাদের
বুকেই। লালন ফকির বলেছিলেন, মনের মানুষ তোমারই প্রতিবেশী। তিনি তোমার মনের মধ্যে
থাকলেও, তার সঙ্গে তোমার দুরত্ব হাজার যোজন। বাবাজী বললেন, এই যে আমরা ‘আমি আমি’
করি এই ‘আমি’টা কে?
বাবাজী বললেন, ক্ষদ্র আমি হলো জীবাত্মা। ভগবান
বুকের মধ্যে থাকলেও, তাকে পাওয়া সহজ নয়। আমার ক্ষুদ্র ‘আমি’ বা জীবাত্মা সেই বৃহৎ ’আমি’
অর্থাৎ পরমত্মার সঙ্গে মিলতে চায়। এটাই ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলন। অর্থাৎ জীবাত্মার
সঙ্গে পরমাত্মার মিলন।
কারণ, আপনার মধ্যেও যে ভগবানের বাস, আমার
মধ্যেও তাই। কারণ, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা
তুমি খুঁজিছ ঈশ্বর?’ এটাই Unity in Diversity’. বহুত্বের মধ্যে এক। আপনারা যারা
এখানে সমবেত হয়েছেন, সকলের মধ্যেই সেই জীবাত্মা রয়েছে। এখানে উপস্থিত এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের মনের
মন্দির ভগবানের মন্দির হয়ে উঠেছে, তাদের জীবন-যাপন, আর আচরণের মধ্য দিয়ে। তাদের
জীবাত্মা সেই পরমাত্মার দেখা পেতে পারে। মিলিত হতে পারে ভক্তি আর বিশ্বাস আর সততার
পথে।
বাবাজী বললেন, তর্কের মাধ্যমে ভগবানকে
পাওয়া যায় না। তর্কের নীটফল শূন্য হয়। চিন্তার মধ্যে থেকে যিনি চিন্তার অতীত, তাকে
লাভ করা যায় না। বিক্ষিপ্ত চিন্তা তাকে লাভ করতে দেয় না। চিত্ত শান্ত না হলে তাকে
পাওয়া কঠিন। আর এই চিত্তের নিরোধই হলো ধর্ম। পরম পুরুষকে লাভ করতে হলে ভক্তির
সাহায্যেই তাকে লাভ করা যায়।
বেকার বলেছিলেন, আমি ভগবানকে মানি না।
এমনকি ‘মানুষ মরণশীল। এই কথাটাও আমি মানি না। কারণ, আজ মানুষ মরনশীল, ভবিষ্যতে
মানুষতো অমরও হতে পারে। বাবাজী মহারাজ বললেন, বিজ্ঞানের গতিপথ ও দর্শনের গতিপথ
এরকমই হওয়া উচিত। কোন কিছুকেই বিনা বিচারে মেনে না নেওয়া।
হয়তো আপনাদের মনে হতে পারে, বাবাজী কি
তাহলে দু রকম কথা বলেছিলেন। একদিকে নির্বিচার আর অন্যদিকে বিনা বিচারে মেনে নেওয়া।
বিষয়টা তা নয়। যারা দার্শনিক, বিজ্ঞানী, তাদের কাজ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে ‘চিরসত্য’কে
পৌঁছে দেওয়া। যদিও ‘চিরসত্য’ কথাটা বিজ্ঞানের চোখে আপেক্ষিক। কারণ, আজকের সত্য
আগামিকাল মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, দর্শন বলে, একটাই চিরসত্য, সেটা হলো আমাদের
এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের একজন মালিক আছেন। বিজ্ঞানে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসে নি।
এই মালিককে দেখানো যায় না। কিন্তু তাকে
উপলব্ধি করা যায়, তার সৃষ্টির মাঝেই। এরপর বাবাজী মহারাজ কী বললেন? তিনি বললেন,
সবকিছুতে সন্দেহ করতে করতে বেকার একদিন বললেন, I cannot doubt that I am doubting.
এর বাংলা মানে হলো, আমি সন্দেহ করতে পারছি না যে আমি আমি সন্দেহ করছি। আবার একটা
হেঁয়ালী। তিনি বললেন – আমি যে সন্দেহ করছি, এটা সত্য। আমি সন্দেহ করছি মানে, আমি
চিন্তা করছি। আর আমি চিন্তা করছি মানে হলো ‘আমি’ আছি। এই ‘আমি’টা কে? সেই ক্ষুদ্র
জীবাত্মা।
বাবাজী মহারাজ বলতেন, মানুষে মানুষে বিভেদ, ভগবানকেই বিভক্ত করা হয়। বাবাজী মহারাজ আইনস্টাইনের একটি
উক্তি প্রায়ই বলতেন। সেদিনও বললেন। কথাটা হল – “The
most incomprehensible thing about the world is that it is at all comprehensible.”
কথাটার অর্থ হলো – সবচেয়ে দূর্বোধ্য ব্যাপার হলো,
এই বিশ্বজগতকে বোঝা যায়। এ এক অদ্ভুত paradox.