Hot Widget

Type Here to Get Search Results !

Advt 720

শিষ্য ‘গুরু’ হলেও, তার মধ্যে ‘শিষ্য-ভাব’ বজায় রাখতে হয়, নইলে ‘প্রকৃত গুরু’ হওয়া যায় না



তারক ঘোষ


 গুরু ও শিষ্য উভয়রূপে শ্রীবাবাজী মহারাজ ছিলেন সন্ন্যাসী ও গৃহী মানুষের আদর্শ। অনেক সময় শিষ্য গুরুহলে, তার মধ্য থেকে শিষ্য ভাবহারিয়ে যায়, প্রকট হয়ে ওঠে তার গুরুভাব। আমি একটা ভিডিও তে দেখেছিলাম, শ্রীবাবাজী মহারাজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক শিক্ষক এসেছিলেন তপোবন আশ্রমে। শ্রীবাবাজী মহারাজ সাষ্টাঙ্গে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে, তার আসনের নীচে বসেছিলেন। এটাই গুরুভক্তি, এটাই শিক্ষাকে সম্মান। এটাই বুঝিয়ে দেয়, শিক্ষক আর গুরুতে কোনো ভেদ নেই। 

 যার মধ্যে, শুধু গুরুভাবপ্রবল, তিনি এই ভাবে পূর্ব জীবনের শিক্ষকের সামনে নত হতে পারবেন না। আমার তাই মনে হয়, ভালো গুরু হতে হলে, ভালো শিষ্য হতে হয়। 



শ্রীবাবাজী মহারাজ ছিলেন
, শ্রীজানকীদাসজীর সুযোগ্য শিষ্য, যিনি প্রতিটি গুরুবাক্য শুধু মেনেই চলেন নি, বাস্তবে তা পালন করে দেখিয়েছেনও। আর এখন গুরু পাওয়া যায় হাজার হাজার, কিন্তু একজন যোগ্য শিষ্য খুব একটা মেলে না, যিনি গুরুর আদর্শকে বহন করে নিয়ে যাবেন, নিজে পালন করবেন, ভক্তদের পালন করার শিক্ষা দেবেন। 

কিন্তু কোথায় সে সব? গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সাক্ষাৎ কতবার হয়, কয়জন স্বেচ্ছায় খবর নেন শিষ্যের? দীক্ষা দেওয়ার পরই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং, দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। কারণ তখন শিষ্যের সব ভার এসে পড়ে গুরুর উপর। এমনকি শিষ্যের খারাপ কাজ স্পর্শ করে যায় গুরুকে। শিষ্য আর গুরু যে এক সুতোয় গাঁথা মালা। এ সব বাবাজীর সামনে বসে থাকতে থাকতে শিখেছি। বাবাজী বলতেন, তার গুরুজী বলেছিলেন –‘আমাদের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ে দীক্ষাদাতা গুরুই শিষ্যের সমস্ত ভার গ্রহণ করেন। 

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ লোকশিক্ষা দিতেন। এটা যে কত বড় শিক্ষা সবাই তা জানেনতার সেই শিক্ষা জীবনমুখী, মানুষকে তার জীবনপথে কীভাবে চলতে হবে, সেই উপদেশ দিয়ে গেছেন, ছোট ছোট গল্প কথার মাধ্যমে। শ্রীবাবাজীকেও দেখেছি, গল্পের মাধ্যমে, শাস্ত্রের জটিল ব্যাখ্যাকে সহজ করে তুলে ধরতেন শ্রোতার সামনে। বাবাজী আর একটি কথা বলতেন শ্মশান বৈরাগ্য। এই শব্দ-বন্ধটার প্রকৃত ব্যাখ্যা নিয়ে ভেবেছি। তার উত্তরও খুঁজে পেয়েছিমাঝে মাঝেই তিনি কেন এই কথা বলতেন, আজ বুঝি তার মানে। 




শ্রীবাবাজীর কাছে নানা ধরণের মানুষ আসতেন। সাধারণ গ্রামের গরীব, অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত থেকে অতি-শিক্ষিত, ধনী, অতি-ধনী। শ্রীবাবাজী মহারাজ কোনদিন  তাদের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। তার কাছে নীচুজাত-উঁচুজাত, ধনী-নির্ধন এর মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। আর এই ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাসীও ছিলেন না। একবার বাবাজী মহারাজ বসে আছেন, পুরানো মন্দিরেরে দাওয়ায়। শিষ্য-ভক্তদের সঙ্গে কথা বলছেন, এমন সময় এক মুসলমান ব্যক্তি এলেন। বাবাজী তাকে দেখতে পেয়েই বললেন, “এই কে আছিস, এঁনাকে একটু বসতে দে, প্রসাদ দে। তিনিও সম্মানের সঙ্গে সেই প্রসাদ গ্রহণ করলেন। 




আসলে, শ্রীবাবাজী মহারাজ কোনদিন ভোলেন নি, তার জীবনে এক মুসলমান শিক্ষকের কথা, যার নাম ছিল মোজ্জাম্মেল হক। শ্রীবাবাজীর কথায়- মোজ্জামেল মাস্টারমশায় টিফিনের সময় আমাকে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে না দিয়ে লাইব্রেরী থেকে রামায়ন, মহাভারত এনে বলতেন, ‘এগুলো পড়।তিনি যখন বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসতেন, দেখতেন, সেই শিক্ষক তার জন্য ডাব হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। শিক্ষকদের এই রূপটা বাবাজী দেখেছিলেন, শিক্ষকের পিতৃরূপ। ভোলেন নি, তাই তার পূর্বাশ্রমের শিক্ষকের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়েছেন। জগতকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন ধর্মগুরু আর শিক্ষাগুরুর মধ্যে কোন ভেদ নেই। তিনি কথা প্রসঙ্গে আর এক মুসলমান রমণীর কথা বলেছিলেন, যিনি তাকে বলতেন –‘আগে খেয়ে নে, তারপর ধর্ম মানিস। 




আপনারা লক্ষ্য করেছেন কি না জানি না, আজ যেখানে বড় মন্দির আর শ্রীবাবাজীর মন্দির, তার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ালে রাতের দিকে যখন নামাজের সুর ভেসে আসে আর মন্দির থেকে ভেসে আসে ওঁধ্বনি, দেখবেন, আপনি দু কানে সেই দুই ধ্বনি একসঙ্গে শুনতে পারছেন। শ্রীবাবাজীর কাছ থেকেই জেনেছিলাম, ধর্মএর প্রকৃত মানে। জীবনের প্রকৃত রূপধর্ম মানুষের মধ্যে মানুষের বিভাজন করে না, মানুষই ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে-মানুষে বিভাজন করে, তার স্বার্থের জন্য। যাইহোক, তিনি শ্মশান-বৈরাগ্য কথাটা যেমন বলতেন, তেমনই বলতেন, ‘ভবী ভোলবার নয়। 




মানব-চরিত্রটা তিনি ভালো বুঝতেন। অনায়াসে বুঝে যেতেন, কে ভালো, কে খারাপ, কে স্বার্থের জন্য তার কাছে পড়ে আছে আর কে নিঃস্বার্থভাবে তার সেবা করে চলেছে। তাই একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন বিষ্ণুদাসজীর কথা। আমি আর আমার স্ত্রী তার পাঠ শুনছি। এটা দ্বিতীয়বারের ঘটনা। সেদিন, অনেক সাধুও এসেছিলেন বাইরে থেকে। বিষ্ণুদাসজীও সেদিন আশ্রমে ছিলেন। বাবা আচমকাই বলেছিলেন, ‘বিষ্ণুদাসকে দেখ, আমাদের চেয়ে কতো এগিয়ে। আসলে, বাবা বুঝে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। তাই শেষের দিকে মনমরা থাকতেন, তার মধ্যে বিষণ্ণতা দীর্ঘ ছায়া ফেলছিলসে কথা পড়ে বলবো। 




শ্মশান বৈরাগ্য। বাবা খুব অপছন্দ করতেন এটা। ভক্তি সবসময়ের। আশ্রমে থাকি বা ঘরেই থাকি। ধর্মকথা শোনা মানে, শুধু আশ্রমে বসে নতমস্তকে তা শুনে যাওয়া নয়। নিজের জীবনে তা পালন করা। বাবা বুঝতেন, অনেকেই এই শ্মশান বৈরাগ্যের শিকার। তাই মাঝে মাঝে কষ্টের সঙ্গে বলতেন –‘তোদের বলেই কী করব, এককান দিয়ে শুনবি, অন্য কান দিয়ে বের করে দিবি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies