নাঃ এই জীবনের জন্য জোটেনি তার সরকারী খেতাব। জোটেনি কোন সরকারী সাহায্য। শিল্পের জন্য দায়বদ্ধ একটা জীবন শুধু শিল্পের প্রেমে মজে আছে বছরের পর বছর।
তারক ঘোষ
এদের জন্য নেই কোন সরকারী অনুদান, নেই নিশিন্ত ভবিষ্যত জীবনের হাতছানি। জীবনের বাঁকে বাঁকে কখনো শিল্পের ছোঁয়া, কখনো বা মৃত্যুর অদৃশ্য উপস্থিতি।
জীবনকে তিনি তিনি নিয়েছিলেন একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে। তাই জীবনের জন্য লড়াই হয়ে উঠেছে, লড়াই এর জন্য জীবনে। মাঠে-ময়দানে হাসিমুখ মানুষের ভিড়, চোখের কোনে অবিশ্বাস, রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহুর্ত আর পরক্ষণেই হাততালির কান-ফাটানো শব্দই এদের জীবনে এগিয়ে চলার প্রেরণা।
আর এভাবেই কেটে গেছে জীবনের কুড়িটা বছর। কখনো বিহারের প্রত্যন্ত জেলায় কখনো বা উত্তরপ্রদেশের বারাণসী, আবার কখনো গ্রাম বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে। জিমন্যাস্টিক আর ম্যাজিককে ভালোবেসে এভাবে মৃত্যুর হাতছানির মধ্যে জীবনের প্রেম খুঁজে পেয়েছিলেন সমীর আখুলি। সাইকেলের নানা ধরণের রুদ্ধশ্বাস খেলা তাকে পরিচিত করেছে মাস্টার সমীর কুমার হিসেবে।
জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন- কখন মরণ আসে কে বা জানে! মরণকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাস্টার সমীর কুমার। কবরের খেলা দেখাতে গিয়ে, মুখের মধ্যে উত্তপ্ত লাল লোহার রড গেলার সময়, কিংবা লেলিহান আগুনের ধারায় স্নান করার সময়।
আর এই শিহরণ জাগানো খেলার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ইশারা। অর্থের জন্য জিমন্যাস্টিক নয়, শিল্পের জন্যই জিমন্যাস্টিক – এই কথাটাই বার বার তার কানের কাছে শুনিয়ে গেছেন জীবন-দেবতা।
এই খেলাটাই কিছু বালতির মধ্যে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরানো হয় তারপর সেই বালতি নিয়ে মাস্টার সমীর কুমার স্নান করেন ..( আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায়)
সমীর কুমার এখনো খেলা দেখান। কিছুটা সংসারের জন্য, কিছুটা শিল্পের জন্য। যে শিল্পকে ভালোবেসে পথে নেমছিলেন বাড়ির উঠান ছেড়ে, সেই শিল্প থেকে কী পেলেন? এই প্রশ্ন কোন শিল্পীকে করা যায় না। সেই প্রশ্নএর উত্তরে শিল্পীরা হেসে বলেন, দর্শকের ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাস। কিন্তু, এতে জীবন চলে কি? এর উত্তরে শিল্পীরা বলেন – প্রত্যেকের কাছে জীবনের সংজ্ঞা আলাদা আলাদা।
সমীরবাবুর জন্ম ১৯৭৩ সালে। বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানার অন্তর্গত ছোট্ট একটি গ্রাম আউসাতে। অভাব-অনটনের সংসার। বাবা-মায়ের ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অভাবে প্রথাগত শিক্ষার চাকা থেমে গেছে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডীর মধ্যেই।
সেই শিক্ষার চাকা না গড়ালেও একসময় ‘চাকা’কেই মাধ্যম করে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। তার নতুন পরিচয় হয়েছিল সাইকেলের মহা জিমন্যাস্টিক মাস্টার সমীর কুমার।
তার সাইকেলের খেলার ছবি দেখলেই বোঝা যাবে।
মাত্র ৯ বছর বয়সে শিশুরা যখন স্কুলে যায়, সমীর যেতেন মিস্টির দোকানে, সাইকেল গ্যারাজে – দু-পয়সা উপার্জনের জন্য। কিন্তু, স্বপ্ন দেখা থামে নি। সাইকেলের দোকানে কাজ করার সময়ই সাইকেল হয়ে উঠছিল তার ধ্যান-জ্ঞান।
এব্যাপারে সমীরবাবু কী বলছেন শোনা যাক -
“এভাবে দু-এক বছর চলার পরেই হঠাৎ দেখি আমাদের বাড়ির পাশে ফুটবল খেলার মাঠে সাইকেল খেলা তথা সাইকেল সার্কাস দেখাতে একটা দল হাজির হয়েছে । বিভিন্ন লোকের মুখে শুনলাম তারা সপ্তাহ খানেক খেলা দেখাবে । এভাবেই কৌতূহলবশতঃ চলে গেলাম একদিন বিকেলে সাইকেল খেলা দেখতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হলো সাইকেলের বিভিন্ন খেলা। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর প্রতিদিনই তাদের খেলা দেখতে যেতাম।
সারাদিন তাদের কাছেই বসে থাকতাম, গল্প করতাম। তারপর হঠাৎ একদিন তাদের দলের হেড বললেন তাদের একজন ছেলে লাগবে তাদের দলে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তাদের সাথে কাজ করবো কিনা। তখন আমি বলেছিলাম আমি তো রাজি কিন্তু আমার বাড়ির লোক রাজি হবে না ... কিন্তু আমি লুকিয়ে যাবো ...।
এই খেলাটার নাম - লায়লা মজনু... এই খেলাটাই মাস্টার সমীর কুমার টিউব লাইট ভাঙেন এবং চিবিয়ে চিবিয়ে কাচ গুলো খান... এই খেলাটা চলাকালীন মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়
তারপর এগিয়ে এলো সেই দিন, আমাদের এখানে লাস্ট খেলা অর্থাৎ কবর খেলা। সেই দিন খেলা দেখিয়ে তারা চলে গেলেন পরের মাঠে অর্থাৎ বর্ধমান স্টেশন এর পাশে একটি জায়গায় এবং আমাকে বলে গেলেন পরের দিন সেই মাঠে চলে যেতে। আমিও পরের দিন ভোরবেলা বাড়িতে না বলেই বাস ধরে চলে গেলাম বর্ধমান স্টেশন চত্বরে।
প্রথমদিন খেলা দেখানোর সময় আমায় বলা হয়েছিল সাইকেল নিয়ে খেলা দেখানোর সময় সাইকেলের ওপর থেকেই ডিগবাজি দিতে। সাইকেল থেকে ইচ্ছা করেই পড়ে গিয়ে নিজেই হাত তালি দিতে . অর্থাৎ মানুষকে হাসানোর কাজ আর কি।
এভাবেই একটা দুটো মাঠে খেলা দেখানোর পর আমি কিছু সাইকেল জিমন্যাস্টিক শিখলাম তারপর আমি আমার গুরুকে বললাম আমাকে কবর খেলা শেখাতে হবে এবং উনি রাজিও হয়ে গেলেন। একটা মাঠে আমাকে কবরে ঢোকানো হলো এক ঘণ্টার জন্য। এভাবেই এ মাঠ সে মাঠ খেলা দেখানোর পর ঘটলো একটা অঘটন - আমার ‘শিক্ষাগুরু’ খেলা চলাকালীন মারা গেলেন।
কবর খেলা। জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। মাটির নীচে ঘন্টার পর ঘন্টা থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।
তারপর আমিও বাড়ি ফিরে আসি, তখন বাবা - মা অনেক বকাবকি করেছিলেন । এরপর নিজেই সাইকেল খেলা দেখানোর সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আমার নিজস্ব কোনো সাইকেল না থাকায় পাশের বাড়ির একজনের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এ পাড়া ও পাড়া সাইকেল খেলা দেখিয়ে নিজের একটা সাইকেল কিনি, মাইক কিনি ।
প্রথমে একা শুরু করলেও ধীরে ধীরে একজন দুজন করে লোকজন শুরু করে। তারপর কখনো বিহারের বিভিন্ন জেলায় কখনো বা উত্তরপ্রদেশের বারাণসী, আবার কখনো গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জেলায় খেলা দেখিয়ে টাকা রোজগার করি।
এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখাতে দেখাতে হাজির হই হুগলি জেলার শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে।
তারপর তারকেশ্বরে বিভিন্ন এলাকায় খেলা দেখানোর পর আসি তারকেশ্বর এর বালিগড়ী এলাকার আকনাপুরে।“
আর সেখানেই জীবনের পথচলা অন্যদিকে মোড় নেয়। জীবন-সংগ্রামে তার দোসর আসেন। একটা পথ মিশে যায় আর এক পথে। খেলা চলাকালীন পরিচয় হয় এক মেয়ের সাথে। পরবর্তী কালে তার সাথেই বিবাহ হয় সমীরবাবুর।
...এরপর বিভিন্ন এলাকায় খেলা দেখিয়ে কেটে গেছে প্রায় ২০ টা বছর। জীবন প্রবহমান। আর সেই ফেলে আসা জীবনের পথের ধারে নানা মুখ। এখনো কান পাতলে শুনতে পান হাততালির শব্দ। এখনো চোখের উপর অবিশ্বাস আর শিহরণের ছায়া দেখেন তিনি।
শুনতে পান টিউব-লাইট ভেঙ্গে কাচ খাওয়ার কচকচ শব্দ।
নাঃ এই জীবনের জন্য জোটেনি তার সরকারী খেতাব। জোটেনি কোন সরকারী সাহায্য। শিল্পের জন্য দায়বদ্ধ একটা জীবন শুধু শিল্পের প্রেমে মজে আছে বছরের পর বছর।
এখনও যখন বিভিন্ন মাঠে বাপির খেলা দেখতে যায়... তখন অনেকেই আমাকে বলেন " তুমি মাস্টার সমীর কুমারের ছেলে !" - তখন খুব আনন্দিত হয়ে উত্তরে " হ্যা" বলি..... সত্যি বলতে খেলা গুলো দেখে অনেক কষ্ট হয় .. কিন্তু খেলা শেষে দর্শকদের হাত তালিতে অনেকটা আনন্দিত হয় ...
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মাস্টার সমীর কুমারের এই বিরল পেশা কে নেটপাড়ার মানুষদের কাছে তুলে ধরার জন্য🙏
ReplyDeleteKhubi bhalo inspiration uni amader jonno
ReplyDelete