ন্যু-ইয়র্কের ফ্র্যাঙ্কলিন স্কোয়ারের দুর্গাপুজো, দুঃস্বপ্ন ভুলে বাঙালি মাতবে আগমনীর আনন্দে
ফ্র্যাঙ্কলিন স্কোয়ার, ন্যু-ইয়র্ক থেকে সুপ্রতীম ঘোষ
আমরা ফিরে এসেছিলাম, কাশফুল ছেড়ে, দামোদরের সেই উত্তাল ঢেউকে পিছনে ফেলে অনেক দূরে এই শহরে। সান্দ্রা ফিরে আসার সময় একমুঠো শিউলি এনেছিল। যেন নিয়ে এসেছিল বাড়ির সেই হারিয়ে যাওয়া দুর্গাপুজোকে। আমার ভ্রাতৃসম সাংবাদিক ও ইংরাজী ভাষার একজন নভেলিষ্ট তারক ঘোষ বলেছিলেন,’ সংবাদ ভয়েস ৯’ এর জন্য কিছু একটা লিখতে প্রবাসের দুর্গাপুজো নিয়ে। তাই পুজোর স্মৃতি নিয়ে কমপিউটারের সামনে...
আমি ফ্রাঙ্কলিন স্কোয়ারের কাছেই হাডসন নদীর কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। আমি আর আমার স্ত্রী সান্দ্রা। ছেলে-মেয়েরা চলে গেছে অনেক দূরে। মেয়ে ইজিপ্টের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় আর ছেলে থাকে ডেট্রয়েটে। আমরা দুজনে এই বিরাট অ্যাপার্টমেন্টে একলা। মাঝে মাঝে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি, কখনো লতা, হেমন্ত মান্না দের গান। সান্দ্রা গান জানে না, কিন্তু বাংলা ভালোই বলে। আমার চেষ্টাতেই ওর বাংলা শেখা। একবার ওকে নিয়ে দুর্গাপুজোয় আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেম। তখন ছেলে মেয়ে হয়নি। পুরানো আমলের বাড়ি, বাইরে রাস-মঞ্চ, চারিদিকে গাছ-পালা, পাখির ডাক।
ও যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। তারপর চারদিন ধরে পুজো, বাড়ির। সে সব দেখে ও আমার বাবাকে বলেছিল, “আমি এখানেই থাকবো।“
আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল কাজের জন্যই। বাবা-মা বলেছিল, এখানে একটা চাকরি নিলে হয়না? আমি কিছু উত্তর দিই নি। বহু বছর পর ছেলেকে বলেছিলাম, এখানেই থাকলে পারতিস।
আমরা ফিরে এসেছিলাম, কাশফুল ছেড়ে, দামোদরের সেই উত্তাল ঢেউকে পিছনে ফেলে অনেক দূরে এই শহরে। সান্দ্রা ফিরে আসার সময় একমুঠো শিউলি এনেছিল। যেন নিয়ে এসেছিল বাড়ির সেই হারিয়ে যাওয়া দুর্গাপুজোকে।
আবার সেই দুর্গাপুজো। গ্রামে আর কেউ নেই, পুজো বন্ধ হয়ে গেছে জ্ঞাতিদের ঝগড়ায়। বাবা-মা চলে গেছেন বহুদিন, আমাকেও যেতে হবে। তবু এখনো কানে বাজে সেই শিয়ালীর ঢাকীদের ঢাক আর কাঁসরের শব্দ। এখন এই হাডসন নদীর জলের দিকে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়াই, যদি সেই সময়টা একবার হাতে চলে আসে। যাইহোক,যা বলছিলাম। এই ফ্র্যাঙ্কলিন স্কোয়ারে দুর্গাপুজো হয়। ফ্র্যাঙ্কলিন স্কোয়ার পার্ল, ডোভার এবং চেরি স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ম্যানহাটনের একটি স্কোয়ার। করোনার কারণে দু বছর সেভাবে হয়নি। এখানকার পুজো কমিটির নাম নিউ ইয়র্ক সার্বজনীন পূজা কমিটি। সবাই বলে ‘বাড়ির পুজো’। এই নামেই পরিচিত ন্যু-ইয়র্কের বাঙালি মহলে।
১৯৮৪ সালে এখানকার দশটি বাঙালি পরিবার এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা চেয়েছিলেন বাংলার সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায়। দেশ ছেড়ে এত দূরে মার্কিন পরিবেশের মধ্যে ওই গুটিকয় হিন্দু বাঙালি তাদের সন্তানদের এবং আগামী প্রজন্মের কাছে ভারতীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বীজ রোপন করেছিলেন সেদিন। আজ কোথায় সেই মূল্যবোধ, কোথায় সেই পারিবারিক বন্ধন। এখানেও সেই ভাঙ্গার খেলা। যাইহোক, বড্ডো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। এই সংস্থাটি NYSDPC (New York Sarbojanin Durga Puja Committee) নামেও পরিচিত।
যারা সেদিন এই সংস্থাটি স্থাপন করেছিলেন, তাদের অনেকেই আজ নেই। জয়শ্রীদি, ভাস্করদা, প্রণবদা মারা গেছেন। জয়শ্রী পাল, ভাস্কর মুখার্জী, ডাক্তার এস, পাইন, ডাক্তার বিমল গাঙ্গুলি, নীতা মুখার্জী, মঞ্জু পাইন, শঙ্কর ভৌমিকরা স্থাপন করেছিলেন এই পুজো। পুজোর দিনগুলোতে
আগে এই পুজো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কারো না কারো বাড়িতে হতো। তারপর দর্শক অনেক বেড়ে গেল। তখন আর বাড়িতে হতো না। এটি এখন আর কারও বাড়িতে সীমাবদ্ধ নয় তবে এখনও ঘরোয়া ভাইব বহন করে। তারা তাদের সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভারতীয় এবং আমেরিকান উভয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানায়
পুজো ধীরে ধীরে চলে এলো ফ্র্যাংকলিন স্কোয়ারে ভিএফডাব্লিউ হলে। এখন শুধু বাঙালি বা ভারতীয় নয়, আমন্ত্রিত হন বহু আমেরিকান বন্ধুও । পুজোর সময় ভোগ বিতরণ হতো, সন্ধ্যায় থাকতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কলকাতা-বোম্বের শিল্পীরা আসতো। সে জেন এক রূপকথা। গ্রামের দুর্গাপুজোতে থাকতে না পারার কষ্টটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো। এখন আবার সেই হারানোর কষ্টটা ফিরে ফিরে আসে।
আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। এই শহরটা প্রতিষ্ঠিত হয় উনবিংশ শতাব্দীতে।
১৮৭০ সালে লিওন জে ম্যাককুলফ জুনিয়র এই শহর স্থাপন করেন। লং আইল্যান্ডে যে প্রথম ক্যাথলিক গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেটা হয় তার বাড়িতে। ফ্র্যাংকলিন স্কয়ারের নামকরণ কেন করা হয়েছে তা কেউ জানে না। কেউ কেউ বলেছিলেন যে এটি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জন্য। তবে এই অঞ্চলের সাথে তার কোনও সংযোগ ছিল না। অন্যরা বিশ্বাস করে যে এটি সেখানকার কোনও অজানা ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়েছিল।