পাড়াম্বুয়ার ১৫৪ তম দুর্গাপুজো শেষ হল ঐতিহ্য মেনেই, বিদায় নিলেন মা ঢাক আর বাজির রোশনাইএ

তারক ঘোষঃ সময়টা বদলেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে বাড়ির মানুষজন, পেশার টানে। এই রাজ্য ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে বিদেশের মাটিতে। কিন্তু, বদলায় নি ঐতিহ্য। তাই নদীর ধারে কাশফুল ফুটলে আর ফেলে আসা বাড়ির আঙিনায় শিউলি ঝরে পড়তে শুরু করলেই মনটা উচাটন হয়ে যায় ঘরে ফেরার জন্য। কলকাতার পুজো-প্যান্ডেল কিংবা এই রাজ্যের বাইরে হাজারো টানকে উপেক্ষা করে ফিরে আসার পালা। এটাই হুগলি জেলার পাড়াম্বুয়ার মন্ডল বাড়ির চিরাচরিত অলিখিত প্রথা, যা চলে আসছে শত বছরের পথ পেরিয়ে এই ২০২২ সালেও। বদলায়নি তার রূপ ও রঙ, আনন্দের সেই চেনা চেহারাটা। ঢাকে কাঠি পড়লেই সবাই তাই ফিরে আসে দেড়শো বছরেরও পুরানো এই পারিবারিক পুজোর মেলায়। এই সুদীর্ঘ সময়ে অনেকেই বিদায় নিয়েছেন, এসেছেনও নতুন। শুধু এক রয়ে গেছে পুজোর চারটি দিনের ছবি।
সবচেয়ে মজার কথা, এই মন্ডল বাড়িতে যারা বউ হিসাবে আসে, তারাও পুজোর সময় বাপের বাড়ি যাবার টান অনুভব করে না, থেকে যায় এই পুজোর অঙ্গ হিসাবে। এমনকি, আধুনিক প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও এই চারটি দিন এই গ্রামের পুজোতেই খুঁজে পায় চিরাচরিত পুজোর অনন্য আস্বাদ। মন্ডল বাড়ির সদস্যবৃন্দের পক্ষ থেকে এই পুজোর যে ইতিহাস জানা যায়, তা অনেকটা এই রকম।


 সময়টা ছিল বাংলা ১২৭৫ সাল। দশঘড়ার জমিদার প্রতি বছর পুজোর আগে দান-ধ্যান ও তার কর্মচারীদের বখশিস প্রদান করতেন। এইসময়, পাড়াম্বুয়ার বাসিন্দা ছিলেন গুরুচরণ ঘোষ, যিনি অনেকটাই যাযাবরী মানসিকতার মানুষ ছিলেন। তার দুই পুত্র – গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ও উদয় চন্দ্র ঘোষ। তারা দুজনেই ওই জমিদারের অধীনে কর্মরত ছিলেন। জমিদার ওই দুজনকেও বখশিস দিলেন। বখশিসের অর্থ পেয়ে তারা ভাবলেন, এই অর্থে তারা মা দুর্গার পুজো করবেন। কিন্তু সেই সময় একক প্রচেষ্টায় দুর্গা পুজো করার কথা ভাবা খুব কঠিন ছিল। একেবারে অসম্ভব বললেই হয়। কারণ, তখনকার দিনে একমাত্র ধনী সম্প্রদায় ও জমিদার ছাড়া ছাড়া আর কেউ এসব কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।

কিন্তু উদয়-গিরীশরা ছিলেন এককথার মানুষ, যা ভাববেন, তাই করবেন। তাই চলতে লাগলো মন্ডল বাড়ির প্রথম পুজোর প্রস্তুতি। কথাটা পাঁচকান হয়ে পৌছে গেল দশঘড়ার জমিদারের কানে। তিনি তো ভেবে পেলেন না, এত অর্থ, এত সাহস কোথা থেকে পেলেন তার ওই সামান্য বেতনভূক কর্মচারীরা। রটানো হল, জমিদারের কোষগার থেকে অর্থ চুরি করে এই পুজোর আয়োজন। তাদের হাজির করা হল জমিদারের সামনে, বিচার হলো। 

তাদের কাছ থেকে সমস্ত কথা শুনে খুশি হলেন দশঘড়ার জমিদার। মুক্তি পেলেন তারা অসম্মানের হাত থেকে। রচিত হল আর এক ইতিহাস। পাড়াম্বুয়ার মন্ডল বাড়ির প্রথম পুজোর ইতিহাস। আজ সেই পুজো ১৫৪ বছর অতিক্রম  করল। এই মন্ডল বাড়ির পুজোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এখানে বলি প্রথার চল নেই।
যাইহোক, পুজো শেষ। মায়ের পায়ে বিজয়ার প্রনাম জানিয়ে সাঙ্গ হয়েছে এ বছরের চিরকালীন সেই পারিবারিক পুজো। মেতে উঠেছিলেন এই বাড়ির মেয়ে-বউ আর পুরুষ সদস্যরা। বিদায়ের দিন নিজেদের হাতে তুবড়ি ও অন্যান্য আলোকবাজি তৈরি করে এ বাড়ির ছেলেরা। তারা বড় হয়ে গেলে, দায়িত্ব নেয় পরের প্রজন্ম। এভাবেই আলোকবাজি, রংমশালের আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাকে। আর এই প্রথা আজও চলে আসছে।   এবার মায়ের ফিরে যাওয়ার পালা।  ফিরে যায় এ বাড়িতে আগত দূরের সদস্যরাও।  যার যার কর্মক্ষেত্রে, অপেক্ষা পরের বছরের।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad