ধর্মক্ষেত্রঃ শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজী; 'যেমন দেখেছি তাঁরে'


ভন্ড ‘সাধু’ মেলে হাজার হাজার, কিন্তু সত্যি সাধু মেলে ক’বার?


আমি তারক ঘোষ, পেশায় সাংবাদিক ও ইংরাজী ভাষার একজন লেখক। দীর্ঘ ৩৬ বছর সাংবাদিক হিসাবে চাকরি করার পর বর্তমানে একটি ডিজিটাল সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক হিসাবে আবার একটা নতুন জীবন শুরু করেছি। আমার সবচেয়ে বড় গর্ব আমি শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী ড. প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিতে পেরেছি। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার স্নেহছায়ায় থাকতে পেরেছি আর এখনো তার স্নেহ ও ছায়ায় আশ্রিত হয়ে রয়েছি। আমার চোখে শ্রীবাবাজী মহারাজের কথা শুরু করতে গিয়ে কয়েকজনের মুখ মনে পড়ছে যারা আজ আমাদের মধ্যে নেই। তারা হলেন স্বামী বিষ্ণুদাসজী, ও তরুণদা। 
আজও যাদের মুখগুলো প্রতিনিয়ত মনে পড়ে তারা হলেন স্বামী রাধামাধব, যাকে প্রথম দেখেছিলাম বাবাজী মহারাজের কাছে। মনে হত, রাধামাধব কর্মযোগের এক প্রকৃত নিদর্শন। শ্রীবাবাজী মহারাজের হুকুম করার সঙ্গে সঙ্গে তা তামিল হয়ে যেত। সদ্য তরুণ সেই রাধামাধব দাসের পাশাপাশি পিসিমার কথাও মনে পড়ে। শুনেছি, তিনি ফিরে গেছেন আসামে। আর একজনের কথা মনে পড়ে। তার নাম ছিল সুকান্ত বাগচি। প্রায় সবসময় দেখতাম শ্রীবাবাজী মহারাজের মুখ নিঃসৃত কথাগুলো লিখে রাখছেন। উনি অবশ্য পরে সাধু হয়ে যান। বর্তমানে স্বামীসদগুরুদাস নামে পরিচিত।


 যাই হোক শুরু করা যাক। আমি তখন ক্লাস নাইনে কি টেনে পড়ি, সালটা ১৯৭৯-৮০ হবে। আমার বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছিলাম হুগলি জেলার এক আশ্রমে। দীক্ষা নেওয়ার জন্য বাবা গিয়েছিলেন। বর্ষাকাল গ্রামের এঁটেল মাটির রাস্তা দিয়ে অতিকষ্টে পৌঁছেছিলাম সেই আশ্রমে। এঁটেল মাটি লেগে পায়ের জুতোজোড়ার ওজন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। যাইহোক, আশ্রমের একটা ঘরে বাবা আমাকে নিয়ে প্রবেশ করলেন। ছোট ঘর। একটা বিছানা। বিছানায় শায়িত এক তেল-চুকচুকে ভদ্রলোক। পেল্লায় চেহারা। উপুড় হয়ে শায়িত আছেন। তার বিছানার উপর দুই মহিলা। ওনার শরীর মালিশ করছেন। দরজার পাশে আশ্রমেরই এক ব্যক্তি। 
বাবার ডাকে বিছানায় শায়িত ওই ভদ্রলোক মাথা তুললেন। বললেন, কিরে, কি ব্যাপার? বাবা বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে এলাম। দীক্ষার ব্যাপারে। উনি একপলক ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলেন। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রণাম কর।‘ আমার তো রাগে কেন জানিনা তখন সারা শরীর রী রী করছে। আমি মাথা গঁোজ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওই ভদ্রলোক তখন আশ্রমের ওই ব্যক্তিকে কী একটা ইশারা করতেই তিনি সোজা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার ঘাড়টা ধরে ওই শুয়ে থাকা ভদ্রলোকের পায়ে ঠুকে দিলেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোজা বাইরে বেরিয়ে গেলাম। 
সেদিন আমার জীবনে দুটো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এক, জোর করে প্রণাম নেওয়ানো আর দুই, একজন ‘গুরুদেব’ মহিলার মালিশ নিচ্ছেন। এরপর আমি আর গুরুদেব, ধর্ম- এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি। ভাবিনি দীক্ষা নেওয়ার কথাও। 


এরপর বহু বছর কেটে গেছে। আমি তখন বর্তমান কাগজ ছেড়ে, আনন্দবাজার গ্রুপের ইংরাজী দৈনিক ‘দি টেলেগ্রাফে’ ক্রাইম সাংবাদিক হিসাবে কর্মরত। সালটা হবে ১৯৯৬। একটা বিশেষ খবর করার জন্য আমাকে তখন মায়াপুরের ইস্কনে যেতে হত। বিষয়টা আজো কিছুটা গোপন, তাই আর বলছি না। ওখানে পরিচয় হয় ভদ্রচারু প্রভুর সঙ্গে। তিনি তখন মায়াপুর ইস্কনের বড় একটা পদে ছিলেন। সেখানে দর্শন করি রাধা-কৃষ্ণকে। 
তখন মন্দির চত্বর শুনশান। ভদ্রচারু প্রভু আমাকে নিয়ে গেলেন মন্দিরে। রাধা, সপ্ত সখী, কৃষ্ণজীকে দেখে সেদিন মনের মধ্যে কী ঘটেছিল জানিনা। মনে হয়েছিল, এই জগতে আনন্দ ছাড়া আর কিছু নেই। মানুষের মনের সব কালিমা একপলকে মুছে যায় রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির দিকে তাকালে। ভদ্রচারু প্রভু সেদিন শ্রীরাধার গলার একটা মালা খুলে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শুনলাম, আপনার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, ওনাকে দিও। আপনার ঘরে কন্যা সন্তান আসবে।‘ ওনার কথা সত্যি হয়েছিল। আমার প্রথম কন্যাসন্তান জন্ম নেয় ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে। 

সেই ভালোবাসা রাধা-কৃষ্ণের প্রতি। এক অমোঘ টান। এর প্রায় ৫ বছর পর আমার জীবনটাই বদলে যায়। আচমকাই আমি জানতে পারি শ্রীবাবাজী মহারাজের কথা, তার আশ্রম তপোবনের কথা। এর পিছনেও আছে আর এক গল্প। যে মানুষটা তথাকথিত কিছু ভণ্ড সাধু দেখে এসেছে। সাংবাদিক হিসাবে তাদের নোংরামী দেখেছে, এমনকি প্রয়াগের কুম্ভমেলা কভার করতে গিয়ে এমন কিছু ভন্ড সাধুদের দেখা পেয়েছি, যাদের ভন্ডামী লিখে বলার মতো নয়। মহিলা, মাদক ও অর্থ ছাড়া এদের জীবনে কিছু নেই। বাইরে জটাজুটধারী অথচ আদপে ক্রিমিন্যাল এরকম বহু ‘সাধু’র জেলযাত্রার খবরও তখন করেছি। 


ইচ্ছা করলেই দীক্ষা নেওয়া যায় না। তার জন্য অন্তরভূমি পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। বিশ্বাস থাকতে হয় অটল আর নিজের স্বার্থের জন্য গুরুদেব খুঁজতে গেলে হয়ত ‘গুরু’ মেলে, কিন্তু সেই সদগুরু মেলে না, যারা কয়েক যুগ পর একজন আসেন। এই ধরাকে পাপমুক্ত করতে, মানুষকে শিক্ষা দিতে।

কিন্তু, আমার জীবনেও একসময় গুরুদেব রূপে এলেন এক মহামানব। 
গুরু সহজে পাওয়া যায় না। প্রকৃত সন্ন্যাসী কয়েক লক্ষে হয়তো একজন পাওয়া যায়। আর ইচ্ছা করলেই দীক্ষা নেওয়া যায় না। তার জন্য অন্তরভূমি পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। বিশ্বাস থাকতে হয় অটল আর নিজের স্বার্থের জন্য গুরুদেব খুঁজতে গেলে হয়ত ‘গুরু’ মেলে, কিন্তু সেই সদগুরু মেলে না, যারা কয়েক যুগ পর একজন আসেন। এই ধরাকে পাপমুক্ত করতে, মানুষকে শিক্ষা দিতে।

 যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ, সাধক বামাখ্যাপা, তৈলঙ্গস্বামী, ওঙ্কারনাথ, লোকনাথাবাবা, কাঠিয়াবাবা, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী,  শঙ্করাচার্যের মতো বহু মহাপুরুষ। আমার শ্বশুরবাড়ির অনেকেই তখন দীক্ষা নিয়েছেন স্বামী জানকী দাস কাঠিয়াবাবাজীর কাছে। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। গ্রামের নাম পাড়াম্বুয়া। হুগলি জেলার ধনিয়াখালি থানা এলাকার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বাবা তারকনাথকে যিনি তারকেশ্বরে প্রথম খুঁজে পান, সেই মুকুন্দদাসের জন্মস্থান পাড়াম্বুয়া।
 কিন্তু, ২০০২ সালে কী এমন হল আমার জীবনে! আমি তার দর্শন পেলাম। না দর্শন নয়, শুধু জানালার পাশ দিয়ে তার চলে যাওয়া। বদলে দিল আমার ধারণাকে। 
(আগামিকাল)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad