শ্রীবাবাজীর সময় আশ্রম থেকে প্রসাদ না পেয়ে কেউ ফিরতেন না,
জ্ঞানের ভান্ডারও উজাড় করে দিতেন ভক্তদের মাঝে
পর্ব ৪
তিনি তখন মহন্ত। কিন্তু মহন্ত-সুলভ আচরণে নয়, গুরু হিসাবে নয়। একজন পিতার মতো দেখতেন ভক্তদের। আজ সেসব ভাবলেই মনে হয়, তিনিই গুরু হওয়ার উপযুক্ত। যার প্রাণ ভক্তের জন্য কাঁদে, তিনিই তো ভক্তের ভগবান।
তারক ঘোষ
জ্ঞানের মূল্য যে অসীম সেটা সকলেই বোঝেন। বহুকাল আগে চাণক্য বলে গিয়েছিলেন –‘বিদ্বতঞ্চ, নৃপতঞ্চ/নৈব তুল্যং কদাচন/ স্বদেশে পূজ্যতে রাজা/বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে ।
শ্রীবাবাজী মহারাজ ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। যারা তপোবন আশ্রমে সন্ধ্যা আরতির পর থাকতেন, তারা জানেন, বাবার সেই প্রবচন, আজো কত প্রাসঙ্গিক। হয়তো, তিনি পূরাণের কোন বিষয় বলছেন, কিন্তু সেই বিষয়কে ভীষণ প্রাসঙ্গিক করে তুলতেন বর্তমান সময়ের নানা নির্দশন দিয়ে। আশ্রমের একজন মহন্ত শিক্ষিত হলে, ভক্তরা কী পেতে পারেন, শ্রীবাবাজীই তার নিদর্শন।
এরপর আর কাউকে পাওয়া যায় না, যার মধ্যে এই জ্ঞান-ভান্ডার আছে। যারা দিতে পারবেন ভক্তদের জটিল প্রশ্নের উত্তর। আসলে সন্ন্যাসী যদি উচ্চ-শিক্ষিত হন, তাহলে যে কী হতে পারে, সেটা শ্রীজানকীদাসজীও দেখিয়ে দিয়েছেন।
আজ, সেসব অতীত। যেমন অতীত হয়ে গেছে আশ্রমে ভক্তদের সেই ভিড়। সেই সারি দিয়ে প্রসাদ নেওয়া। যারা আশ্রমে থেকে যেতেন, তাদের ফেরার সময় হলে শ্রীবাবাজী বলতেন, “সে কিরে, এর মধ্যেই চলে যাবি? আর কয়েকটা দিন থেকে যা না।“ আজ আর কেউ বলবে? আমি জানি, বলবে না। আশ্রমের সেই স্বর্ণমাখানো জ্ঞান-দানের দিন যেমন শেষ, তেমনই শেষ, প্রসাদ পেয়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য।
এগুলো আর হবে না। কারণ মহন্ত আসে হাজার হাজার, কিন্তু মহাপুরুষ আসেন লক্ষে এক। আবার আমরা যদি তাকাই শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে। তিনি তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ না হয়েও ছিলেন এক অতি-উচ্চশিক্ষিত মহাপুরুষ। যার মধ্যে ঈশ্বরের আবাস ছিল।
আজ কোথায় সেসব।
আশ্রমে গেলে কে দেবে তাপিত হৃদয়ে স্নেহের ছায়া, কে শোনাবে শ্রীগীতা, পুরাণ, বেদ-বেদান্তের বাণী? কে বাতলাবে সৎ-পথের দিশা। সেই জ্ঞান, সেই আশ্রম আজ অতীত।
থাক সেসব কথা।
যারা শ্রীবাবাজীর প্রকৃত শিষ্য তারা জানেন, আমি ঠিক বলছি, না ভুল। হাজার হাজার মানুষ আশ্রমে যে সেবা পেয়েছেন, তারা তা জানেন। যে জ্ঞান তারা শ্রীবাবাজীর কাছ থেকে পেয়েছেন, তারা সেটা জানেন। কেউ মুখে স্বীকার করুক বা না করুক, নিজেরা জানেন, শ্রীবাবাজীর না-থাকাটা এক বিরাট শূন্যতা। যারা তাকে গুরু মেনেছিলেন, তারা আশ্রমে মাঝে মাঝে গেলেই বুঝবেন, এক বিরাট অভাব তাদের ঘিরে ধরেছে।
কিন্তু, পৃথিবী ছেড়ে যেতেই হয়। সকলেই একদিন চলে যাবেন। কারণ এটা এক পান্থশালা। কিন্তু, যাবার আগে একটা দাগ রেখে যেতে হয়, যাতে ভবিষ্যত বোঝে কেউ একজন জন্মেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, দাগ রেখে যা। নিজের সৎ কর্মের দাগ, নিজের সৃষ্টির দাগ – যে দাগ ধরে এগিয়ে চলবে ভবিষ্যত প্রজন্ম।
আর কিছুই যদি রেখে যেতে না পারে কেউ, তাহলে তার জন্ম বা মৃত্যু কোনটাই মনে রাখবেন না কেউ
আজ শ্রীবাবাজীর কয়েকটা কথা বলব। কারণ, তিনি এমন এক পুরুষ ছিলেন, এমন এক তপস্বী ছিলেন, এমন এক মহন্ত ছিলেন, এমন এক কর্মযোগী ছিলেন, যার বিকল্প হওয়ার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারবেন না।
২০০৩ সাল। এক আনন্দের হাট ছিল। শ্রীবাবাজী পুরানো মন্দিরের দাওয়ায় আসনে বসে আছেন। গোশালায় গরু, পাশে অতিথিদের জন্য রান্নার তোড়জোড় হচ্ছে। তখন, পুরানো মন্দির যেখানে আছে, তার উল্টোদিকে অতিথি-নিবাস।
শ্রীবাবাজী মহারাজ শ্রী ১০৮ স্বামী জানকীদাস মহারাজ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন। ক্ষমা করবেন, আমি চলিত ভাষায় তার মর্মার্থটা লিখছি। তিনি লিখছেন –“পরম্পরারূপে আসা গুরুশক্তি যিনি লাভ করেননি, তিনি যত ক্ষমতাশালীই হন না কেন, শিষ্যকে তিনি কোনদিন মোক্ষ লাভ করাতে পারবেন না।“ শ্রীবাবাজী মহারাজ তার গুরু সম্পর্কে লিখছেন – ‘কোন গৃহস্থ শিষ্য আশ্রমে এসে, কিছুদিন থাকার পর ফিরে গেলে তার চোখ জলে ভরে যেত।‘ তার গৃহস্থ শিষ্যরা বলতেন,বাবার কাছে কোন সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি পোস্ট করলেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। গৃহস্তের সব সমস্যা তিনি মন দিয়ে শুনতেন। বলতেন, ওরা আমার কাছে বলবে না তো, কার কাছে বলবে?”
এসব শ্রীবাবাজী তার প্রবন্ধে লিখে গেছেন। শ্রী সদগুরুদাসজী সংকলিত ‘প্রবন্ধ পারিজাত সমগ্র’ গ্রন্থে পাবেন। আমি এই কথাগুলি উল্লেখ করলাম কেন জানেন?
শ্রীবাবাজী মহারাজ শ্রীদাদাজী মহারাজের সেই কথা, সেই আচরণ নিজেও পালন করে গেছেন, যতদিন দেহে ছিলেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে এই নীতি নিয়ম অনুসরণ করে গেছেন। এখন এই নিয়ম পালন করা হয় কি না আমি জানিনা। তবে, আমি মনে করি, গুরুর আদর্শ বয়ে নিয়ে যাওয়াটাই পরম্পরা তথা শিষ্যের কর্তব্য।
শ্রীগুরুর আদর্শ, বাণী মেনে চলা, সকলের কাছে তার জীবনাদর্শ তুলে ধরা, তিনি যে পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন, সেই পথে চলাই হলো গুরুসেবা। তিনি গৃহি শিষ্যই হোন বা সাধু শিষ্যই হোন।
যা বলছিলাম, আমি আমার শাশুড়ী, স্ত্রী ও ৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে চৈত্রের এক দুপুরে প্রথম যাই নতুনগ্রামের তপোবন আশ্রমে। তখন আশ্রমের চারিধারে এরকম প্রাচীর ছিল না, সুদৃশ্য প্রবেশপথ ছিল না। ছিল শুধু আমবাগান, সেখান থেকে ভেসে আসছিল কোকিলের ডাক। আমরা অগ্রদ্বীপ স্টেশন থেকে মাঠ পেরিয়ে হেঁটেই গিয়েছিলাম। তখন আশ্রমের নিয়ম-কানুন কিছুই জানতাম না।
কিন্তু যে কথাটা আজো মনে আছে, তা হলো শ্রীবাবাজী মহারাজের উজ্জ্বল দেহকান্তি আর সুমধুর কণ্ঠে বলা কথা –“তোদের আসতে এতো দেরী হলো? যা, বেলা হয়েছে, আগে প্রসাদ পেয়ে নে।“ কথাগুলো বলে ডাক দিলেন,”রাধামাধব, এদের প্রসাদ পাওয়ার ব্যবস্থা কর।“ বেলা প্রায় ২ টা আড়াইটা বেজে গেছে তখন।
এ
ই প্রসাদ পাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। কে লিখেছিলেন, আজ মনে নেই। কথাগুলো এইরকম – একবার বেলার দিকে কয়েকজন ভক্ত এসেছেন। সকলের প্রসাদ পাওয়া হয়ে গেছে। কেবল বাবাজী তখনো পান নি। খবর এলো ভক্তদের দেওয়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু শ্রীরাধা-কৃষ্ণের কাছে এসে ভক্তরা অভূক্ত থাকবেন। বাবাজী আর থাকতে পারলেন না। নিজের প্রসাদ ভাগ করে দিলেন ভক্তদের মধ্যে।
এই ছিলেন বাবাজী মহারাজ। তিনি তখন মহন্ত। কিন্তু মহন্ত-সুলভ আচরণে নয়, গুরু হিসাবে নয়। একজন পিতার মতো দেখতেন ভক্তদের। আজ সেসব ভাবলেই মনে হয়, তিনিই গুরু হওয়ার উপযুক্ত। যার প্রাণ ভক্তের জন্য কাঁদে, তিনিই তো ভক্তের ভগবান।
আগামিকাল