শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২৩


সাম্যবাদের সঙ্গে ধর্মের মিলনেই আসতে পারে প্রকৃত শান্তি, সুস্থ সমাজ ও সামাজিক শৃংখলতা 


    
তারক ঘোষ
 পর্ব ২৩ 

 পদ অনেকেই পেতে পারেন, ধর্মীয় উচ্চ পদে অনেকেই আসীন হতে পারেন, কিন্তু সকলেই জ্ঞানী হতে পারেন না, সকলেই মুক্ত চিন্তার ধারক ও বাহক হয়ে উঠতে পারেন না, সকলেই নবজাগরণের পথিকৃৎ হতে পারেন না। 
কেননা, এটা লাভের জন্য প্রয়োজন অসামান্য জ্ঞান, শিক্ষা, অধ্যাবসায় আর স্বাধীন চিন্তার বিস্তার। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বেদ-পুরাণ, উপনিষদ সম্পর্কে বৈজ্ঞানীক ধ্যান-ধারণা প্রয়োজন। 
গুরু হওয়া সহজ, কিন্তু ‘শিষ্যকে’ দেওয়া অত সহজ নয়। ফলে, একশ্রেণির গুরুরা শিষ্যের কাছ থেকে নিয়ে যান, কিন্তু দিতে পারেন না। কিন্তু গুরু কী দেবেন শিষ্যকে? অর্থের সন্ধান? নীরোগ জীবনের চাবিকাঠি? সমস্যা-বিহীন জীবনের গ্যারান্টি? ছেলে-মেয়েদের চাকরি-বিবাহের সুলভ আশ্বাস? না কি পরমার্থের সন্ধান? চেতনা? 


ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। তার জন্য আলাদাভাবে শিক্ষিত হতে হয়নি। কিন্তু সবাই তা নন। সেই তিনিও মানুষের চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন তার অসামান্য লোক-শিক্ষার মাধ্যমে। 
আমাদের গুরুদেবও সেই চেষ্টা করেছিলেন, কারণ ঠাকুর রামকৃষ্ণ ছিলেন তার কাছে অত্যন্ত সম্মানের এক মহাপুরুষ। পাশাপাশি তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও মহানাম ব্রম্ভচারীর আদর্শকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি উচ্চ-শিক্ষার অধিকারী ছিলেন বলেই সমাজ ও সংষ্কৃতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার কথা ভাবতে পেরেছিলেন। 
সব গুরু শিষ্যকে চেতনা দিতে পারেন না। দিতে পারেন না, জীবনে শান্তির সঠিক পথ বাতলে দিতে, তাই সব গুরু শিক্ষক, সমাজ-সংষ্কারক বা ধর্মীয় নব-জাগরণের পথ-প্রদর্শক হতে পারেন না। আত্মজ্ঞান/ব্রম্ভজ্ঞান লাভ না করেই, সব গুরুই সদগুরু হতে পারেন না, কারণ, সদগুরুই ভগবান। তিনি গুরুরূপে শিষ্যকে দিয়ে যান চেতনার সন্ধান, যে চেতনা তাকে নিয়ে যায় পরমার্থ-প্রাপ্তির দিকে। 
এই সদগুরু লাভের কথাই, সদগুরু চেনার কথাই আমাদের বাবাজী বারে বারে বলতেন। আর একটি বিষয় নিয়ে না বললে, আমাদের বাবাজী অর্থাৎ ডক্টর প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া, এম এ, এম ফিল, গোল্ড মেডালিস্টকে চেনা সম্ভব নয়। নাহলে তাকেও অন্যান্য গুরুদের দলে ফেলে দেওয়া হবে। সেটি হল তার সমাজ-চেতনা। 

সকলেই জানেন, তার গবেষণার বিষয় ছিল মার্ক্স ও নিম্বার্কের চিন্তাধারায় সমাজ। যাদের এই দুটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা আছে, তারাই বুঝবেন, কী কঠিন এই বিষয়ে গবেষণা। আপাত-দৃষ্টিতে নিম্বার্কবাদ, সনাতন ভারতীয় ধারণা। আর তার সঙ্গে বিদেশের মার্ক্স-তত্ব। 
কিন্তু, কেন বাবাজী এই দুটি বিষয়কে বেছে নিয়েছিলেন? যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তার কারণ, তার আধুনিক সমাজ-চেতনা। তিনি বুঝেছিলেন, ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা পেতে হলে, সাম্যবাদ প্রয়োজন। আবার ধর্মকে বাদ দিয়ে সাম্যবাদ আনার চেষ্টা করলে, তার ফল ভালো হয় না। পাঠকগণ, এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজবেন না, কারণ, এটা সমাজ-বিজ্ঞানের একটা অংশ। 


বাবাজী বলছেন – “সাম্যের জাগরণ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থা ও জীবনচর্যার মধ্যে। পরিশীলিত শৃংখলতা মানুষকে আত্মবোধে বা সাম্যবোধে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাই সাম্যবাদ কোন মুখস্থ বুলি ছিল না, ছিল অন্তরের আন্তরিকতা।“ 
তিনি বলতেন, ‘সাম্যের জাগরণ না ঘটলে সবই নিছক কথাতে পরিণত হয়। কেন এ কথা তিনি বলেছেন? আমরা ফিরে যাই সূদূর অতীতে। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় বলা হয়েছে – 
“যাবত ভ্রিয়েত জঠরম তাবত স্বত্বং হি দেহিন… 
অধিকং যোহভিমন্যেত স স্তেনো দণ্ডমর্হতি।।“ (৭/১৪/৮) 
এর বাংলা অর্থ হল – যতটুকুতে একজনের গ্রাসাছাদন চলে, সমাজ থেকে সেটুকুতেই তার অধিকার, যদি সে অতিরিক্ত সে নেয়, তাকে শাস্তি পেতে হয়। বাবাজী বলছেন –পুঁজিবাদকে এ ভাবেই প্রাচীনকালে নস্যাত করা হয়েছে। আর তার বাস্ত রূপায়নের জন্য অনুসাসনও ছিল। 
বাবাজী রন্তিদেবের উপাখ্যান তুলে বলেছেন – “রাজা বলেছেন –‘আমি ব্যক্তি সুখ চাই না, মুক্তি চাই না, সমস্ত দুঃখী মানুষের দুঃখ আমার কাছে আসুক, তারা সুখী হোক, এটাই আমি চাই।‘ – সাম্যবোধের কী অপরূপ সমাপ্তি।“
 

বাবাজী বলেছেন –‘সম’ শব্দটির সাধারণ অর্থ সমান ভাব। শ্রীগীতায় বলা হয়েছে – 
“বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাম্ভণে গবি হস্তিনি। 
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পন্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।।“
 এর বাংলা অর্থ হল – জ্ঞানী মানুষরা - বিদ্যা ও বিনয়ী ব্রাম্ভণ, গোরু, হাতি, কুকুর এবং চণ্ডালকে সমান দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। 
বৈদেশিক সাম্যবাদের শুধু মানুষ নিয়ে চিন্তাভাবনার চেয়ে তাই গীতা অনেক এগিয়ে। বাবাজী বলতেন, ‘সাম্য নিজেই সাধনা, নিজেই সিদ্ধি।‘ ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে – ধর্মের সার হল, যা নিজের কাছে খারাপ, দুঃখকর বা প্রতিকূল, সেই আচরণ অন্যের সঙ্গে করবে না।
আগামিকাল...

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad