দীক্ষা দেবার আগে গুরুদেব দেখেন, ভক্তের মনের জমি ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে কি না, নইলে মন্ত্রের বীজ ঠিকমত অঙ্কুরিত হয় না।
তারক ঘোষ
শ্রীবাবাজী মহারাজ তার গুরুদেব শ্রীশ্রী স্বামী জানকীদাসজীর সম্পর্কে লিখছেন –“শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ তার কোন অন্তরং শিষ্য সম্পর্কে বলছেন – গুরুদেবের কাছ থেকে ছোট্ট মন্ত্র লাভ করেছো, তোমাকে কাচ দিলাম, না, কাঞ্চন দিলাম নিজের জীবনে একটু পরীক্ষা করে দেখো।“
সেদিন ছিল ১২ ই চৈত্র, ২০০৩ সাল। বাংলার সালটা ঠিক মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে। সন্ধ্যা আরতির পর বাবা বসলেন পাঠে। নতুনগ্রামের মানুষজন যেমন আছেন, তেমনই বাইরে থেকে আসা ভক্ত-শিষ্যরাও রয়েছেন। তখন ভক্তরা এলে থাকার ব্যবস্থা হতো। এমনকি, আগাম জানিয়ে না এলেও। তাদের থাকা বা প্রসাদ পাওয়ার কোন অসুবিধা হতো না। কারণ, শিষ্য ও গুরুদেবের মধ্যে ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, এখনকার মতো নয়। আর সে কারণেই শ্রীবাবাজী সাধারণ মানুষ ও ভক্তদের ‘প্রাণের মানুষ’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
আমি মনে করি, আর কারও পক্ষে এটা আপাততঃ সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী বাবাকে বাতাস করছিলেন। গ্রামের এক মহিলা বাবার জন্য কিছু এনেছিলেন। বাবা সেই খাদ্য গ্রহণ করলেন। তারপর রাধামাধবকে বললেন লজেন্সের প্যাকেট আনতে। নিমেষের মধ্যে বয়াম ভর্তি লজেন্স হাজির। শ্রীবাবাজী পরম স্নেহে সেই লজেন্স বিলিয়ে দিলেন উপস্থিত শিশুদের মধ্যে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলার আছে, বাবাজীর মধ্যে যেমন জ্ঞানের একটা ভান্ডার ছিল, তেমনই ছিল মানুষের উপর এক গভীর বিশ্বাস, ভালোবাসা। তাই তার হাসি ছিল শিশুর মতো সরল, একটু কালিমা ছিল না সেখানে। সেই হাসি আজ কোথায়!
শ্রীবাবাজী একটা গ্রন্থ থেকে পাঠ করতে যেতেই, এক মহিলা উঠে বললেন, বাবা, আমি আর আমার স্বামী দীক্ষা নিতে চাই। বাবা, বই থেকে মুখ তুলে বললেন, “ কেনরে?”
ভদ্রমহিলা মহিলা বললেন, “আমাদের বাড়ির সবাই নিয়েছেন, তাই…”
শ্রীবাবাজী একটু মৃদু হেসে বললেন,”ওঃ”
তারপর ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললেন, “দীক্ষার আগে গুরুকে একটু বাজিয়ে দেখবি না, গুরু তোকে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারবে কি না।“
ভদ্রমহিলা মাথা নীচু করে রয়েছেন।
আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। বেশির ভাগ ‘গুরুদেবরা’ যেখানে দীক্ষা দিয়ে শিষ্য-সংখ্যা বাড়ানোর জন্য রীতিমতো প্রা্ণপণ ‘লড়াই’ করছেন, সেখানে ইনি এ কী কথা বলছেন। ‘গুরুকে বাজিয়ে দেখা’?
শ্রীবাবাজী বললেন, “দেখো, ছেলে-মেয়ের টিচার খোঁজার সময় যাচাই করে নাও তো, কে ভালো পড়ায়, কার কাছে দিলে ছেলে-মেয়ে ঠিক-ঠাক শিখবে, ভালো রেজাল্ট করবে, তাই না? এটাও ঠিক তেমনি, যার কাছে, বাকি জীবনটাই সঁপে দিচ্ছো, তিনি সদগুরু কি না, তা একবার বাজিয়ে দেখবে না?”
তিনি তখন ভক্ত কে, তার ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, “ভক্ত কে? ভক্ত হলো সে, যে আমার কাছে কিছু চায় না, শুধু আমাকেই চায়। যে আমার কাছে কোনদিন সংসারের কোনো জিনিষ চায় না, তিনিই ভক্ত। আমি যদি তাকে দুঃখও দিই, সে শুধু আমাকেই চায়। বলে, ‘সুখে কেন রাখবে আমায়, রাখো তোমার কোলে।‘ ভক্ত প্রহ্লাদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, প্রহ্লাদ ভগবানের অনুরোধ মেনে বর নিয়েছেলেন।
কী বর জানো? তিনি বলেছিলেন, যদি বর দিতেই হয়, তাহলে আমাকে এমন বর দিন, যাতে আমার মধ্যে কোন কামনা-বাসনা না থাকে।“
শ্রীবাবাজীর কথা তখন আমার কান ভেদ করে মনের মধ্যে ঢুকতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলাম সিগারেট খেতে বাইরে যাব। এই গুরুদেবের কাছে আজ আমার প্রথম দিন। তার ডিগ্রির দিকে তাকিয়ে ছুটে এসেছিলাম এখানে। কেন, তিনি নিজের জীবনকে সুরক্ষিত না করে, অন্যের ভালো করার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। অন্য গুরুর সঙ্গে এই গুরুদেবের কী পার্থক্য তা বোঝার জন্য। যেখানে, শুনি, একশ্রেণির ‘গুরু’ শুধু প্রণামীর আশায় শিষ্য-সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নির্বিচারে দীক্ষা দিয়ে যান, ইনিও কী তাই?
কিন্তু, এ আমি কী দেখছি। অবশ্য সব দেখা তখনো হয়নি, কিন্তু তার মধ্যেই আমি আটকা পড়ে গেছি। এক অদ্ভুত টান অনুভব করছি তার কথায়।
বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা তখন হারিয়ে গেছে।
শুনছি তার কথা। তিনি বললেন, এই সংসারে ৪ ধরণের ভক্ত আছে। যেমন, কেউ বিপদে পড়ে ডাকে। তারা হলেন আর্ত ভক্ত। কেউ অর্থের জন্য ডাকে, তারা অর্থাথি। আর আছেন জিজ্ঞাসু ভক্ত, যিনি জানতে চান আর শেষ ভক্ত হলেন যিনি ভগবানকে জানতে চান আর তার কাছে থাকতে চান।
সেদিন শ্রীবাবাজীর সামনে অনেক ভক্ত। কেউ এসেছেন, নিজেদের সংসারের অশান্তির কথা বলতে, কেউ এসছেন তার মেয়ের বিবাহের ব্যাপারে, কেউ এসছেন ছেলের চাকরির ব্যাপারে জানতে। কিন্তু নিছক জানার জন্য, জ্ঞানের জন্য বা ঈশ্বরলাভের পথ বা পন্থা কী, তা জানার জন্য কতোজন এসেছেন? সব গুলিয়ে যাচ্ছিল, ‘ভক্ত’ সম্পর্কে বাবার ব্যাখ্যা শোনার পর। আজ এতদিন পর, বাবার প্রয়াণের পর বাবার বলে যাওয়া সেই ভক্তদের ব্যাখ্যাটা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এরপর বাবা একটু চুপ করে থেকে ওই মহিলাকে বললেন, “দীক্ষা দেবার আগে গুরুদেব দেখেন, তার মনের জমি ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে কি না, নইলে মন্ত্রের বীজ ঠিকমত অঙ্কুরিত হবে না। দীক্ষা দেওয়াই যায়, কিন্তু তার আগে তুমি নিজেকে একবার যাচাই করে নাও।“
দীক্ষা নেওয়ার আগে শিষ্যের উচিত গুরুকেও যাচাই করে নেওয়া। নইলে, যে উদ্দেশ্যে গুরুকরণ, সেটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কথাগুলো আমার নয়। ভারতের জ্ঞান-তপস্বী সাধকদের জীবন-দর্শনের অভিজ্ঞতার ফসল এই কথাগুলো। বাবাজী মহারাজের (শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া বাবাজী মহারাজ) মুখেও বহুবার এই কথাগুলো শুনেছি।
তিনি বলতেন, গুরুকেও যাচাই করে নেওয়া দরকার। গুরু যেমন শিষ্যকে পরীক্ষা করে নেবেন, তেমনই শিষ্যকেও বুঝে নিতে হবে, সে যেন প্রকৃত সদ্গুরুর সন্ধান পায়।
গুরুর কাজ হল শিষ্যদের জীবনের পথে সঠিকভাবে চলতে শেখানো। জীবন, জগৎ ও ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে তাদের অবহিত করা। নানাস্থানে ভ্রমণ ও প্রবচনের মাধ্যমে আদর্শ ও প্রকৃত ধর্ম কথার প্রচার। এককথায় তিনি হলেন শিষ্যদের জীবনপথের কাণ্ডারী।
অন্যদিকে, শিষ্যদের মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র, তাদের ব্যক্তিজীবনের সমস্যার সমাধান করা, কিংবা, তাদের অর্থ-প্রতিপত্তি, চাকরি পাইয়ে দেওয়াটা গুরুদেবের কাজ নয়। আমি বহু ভক্তকে দেখেছি, যারা নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির উদ্দেশ্যে গুরু খুঁজে বেড়ান, দীক্ষা নেন। কিন্তু গুরুর কাছ থেকে ‘আশানুরূপ ফল’ না পেয়ে নিমেষে সেই গুরুকে ত্যাগ করে অন্য গুরুর সন্ধানে বের হয়ে পড়েন।
এরকম বহু শিষ্য আছেন, যারা অন্যায় পথে রোজগার করা অর্থ আশ্রমে বা গুরুর পায়ে সমর্পন করেন। এটা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় অপরাধ।
তারা মনে হয় জানেন না, তাদের সেই পাপের অর্থ পরোক্ষে বিড়ম্বনা হয়ে যায়। এই পাপের অর্থ জেনে বা না জেনে গ্রহণ করলে, স্বয়ং গুরুদেবকেও সেই পাপের ভাগী হতে হয়। শিষ্যের পাপ গুরুকেও স্পর্শ করে, যদি তিনি প্রকৃত সদ্গুরু হন। বাবাজী মহারাজ বলতেন, হাজার হাজার গুরু পাওয়া যায়, কিন্তু একজন প্রকৃত শিষ্য পাওয়া খুব কঠিন। তিনি বলতেন, প্রকৃত সাধক কখন বিত্তের দাস হবেন না, কামনা, বিত্তবাসনা থেকে হাজার যোজন দূরে থাকবেন।
কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, এই সমাজে এমন অনেক ‘গুরুদেব’ আছেন, যাদের লক্ষ্য থাকে অর্থের দিকে, নানাভাবে তারা অর্থের পিছনে ছুটে চলেন। ঈশ্বর সাধনা ভুলে, তারা অর্থের সাধনায় দিনাতিপাত করেন, বাড়িয়ে চলেন শিষ্যের সংখ্যা।
এদের সম্পর্কেই কাঠিয়াবাবা বলেছেন “সদ্গুরুকো পায় লাগ, ঝুটা গুরুকো মার লাথ।“ তবে, এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, সদগুরু চেনা খুব কঠিন। বাবাজী মহারাজ লিখেছেন – “গুরু একটি আদর্শ। শ্রী ভগবানই গুরু।
শ্রীগুরু শ্রী ভগবানকে পাইবার পথ। ব্যক্তি গুরু যতক্ষণ এই আদর্শের সঙ্গে যুক্ত ততক্ষণই তিনি গুরু। যখন তিনি এই আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট, তখন তিনি কেবল ব্যক্তিমাত্র। এই তত্ত্ব সাধারণ ভক্তের কাছে বোঝা খুব কঠিন। কারণ সাধারণ ভক্ত গুরু বলিতে মনে করেন যে গুরুদেব যাহা করেন তাহা সবই ঠিক। তাহাদের কাছে —
“যদ্যপি মোর গুরু শুঁড়ীবাড়ী যায়,
তথাপি মোর গুরু নিত্যানন্দ্য রায়।“
এই আদর্শ সমাজের পক্ষে কল্যান দায়ী, স্বাস্থ্যকর হয় নাই। এই আদর্শ এক সু-উচ্চ আদর্শ। গুরুর বাক্য নির্বিচারে পালনই এই আদর্শের প্রাণ। ইহাই যথার্থ আধ্যাত্ম মার্গ।
কিন্তু ভক্তের এই নির্বিচার ভাবের সুযোগ লইয়া অনেক সাধারণ মানুষ, নারীপুরুষ ‘গুরু’ সাজিয়া বসিয়াছেন এবং শিষ্য ইহাদের পাল্লায় পরিয়া সর্বনাশপ্রাপ্ত হন। এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলা হইয়াছে – “শিষ্যের সন্তাপ অপহারক গুরুর সংখ্যা খুবই কম, কিন্তু বিত্ত অপহারক গুরুর সংখ্যা অনেক।“
দীক্ষা নেওয়ার আগে গুরুকেও সঠিকভাবে চিনে নেওয়া একজন প্রকৃত শিষ্যের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রাথমিকভাবে মনে রাখতে হবে …
১) সাধক তথা গুরু হবেন কামনা-বাসনাহীন পবিত্র এক সন্ন্যাসী।
২) সন্ন্যাসের প্রকৃত অর্থ তিনি যেমন জানবেন, নিজের জীবন-যাত্রাতেও তারই প্রতিফলন ঘটাবেন।
৩) তিনি হবেন নির্লোভ, সকলের প্রতি আন্তরিক, বিনয়ী। ভোগ-বাসনা, বিলাসিতা থেকে অনেক দূরে থাকবেন তিনি।
৪) তার নিজের আচরণ যেন তার দেওয়া উপদেশ থেকে ভিন্নমুখী না হয়।
আগামীকাল