শ্রীগীতার আদর্শে আলোকিত তার জীবন –জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ আর কর্মযোগের মূর্ত রূপ তিনি
তারক ঘোষ
পর্ব ১৩
শ্রীবাবাজী বলতেন, গুরুর কাছ থেকে মন্ত্র বা দীক্ষা লাভ হলেই গুরু লাভ হয় না। গুরু যতদিন না ‘আমার’ হন, ততদিন গুরুলাভ সম্ভব নয়। ‘গুরুলাভ’ করতে হলে শিষ্যকে নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেমন এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে উঠতে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে, এ ক্ষেত্রেও তেমনই। এই পরীক্ষায় পাশ করলেই পৌঁছানো যায় সেই আ্নন্দময় স্থানে, যেখানে গুরু আর ভগবানে পার্থক্য থাকে না।
গুরু সর্বদা আনন্দময় বালকের মতো সরলরূপে থাকেন, তার কোনো কথা ‘হাস্যজনক’ মনে হতে পারে, কিন্তু সেটা শুনে শিষ্যের বাচালতা যেন প্রকাশ না পায়। মনে রাখতে হয়, গুরু যদি কাউকে বেশি স্নেহ করেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার উপর নিজ অধিকার ফলাতে নেই। মনে রাখা উচিত, গুরুর মনঃকষ্টের কারণ হলে তার ফল জন্ম-জন্মান্তর ধরে ভোগ করতে হয়।
বাবাজী মহারাজ আর একটা কথা প্রায়ই বলতেন – গুরু যদি শিষ্যকে সত্য এর পরিবর্তে মিথ্যা বলতে বলে, শিষ্যকে তাই বলতে হবে। এটা শিষ্যকে অহঙ্কার থেকে মুক্তি দেয়। তিনি তার পূর্বসূরীদের কথা উল্লেখ করে বলতেন – গুরুকে আগে যাচাই করতে হয়, তারপর তার কাছে দীক্ষা বা মন্ত্র নেওয়ার প্রশ্ন। ধান্দাবাজ গুরুবেশীদের ছায়া মাড়াতে নেই।
কথাগুলো ভেবেছিলাম। আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলাম, সেই রামদাসজী কাঠিয়াবাবার সময় থেকে এই এক কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন কাঠিয়াবাবারা। আমাদের বাবাজী তার বিশদ ব্যাখ্যা দিতেন, যা থেকে আপনাদের জানাই – আমরা যখন উকিলের কাছে যাওয়ার আগে ভেবে নিই, যার কাছে যাচ্ছি, সেই উকিল আমাকে মামলাতে জেতাতে পারবেন তো? আমরা যখন রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে যাই, ভেবে নিই, তিনি রোগ সারাতে পারবেন তো? আমরা যখন কোন জিনিষ কিনি, যাচাই করে নিই, তার গুণাগুণ।
তাহলে, গুরুকরণের আগেও যাচাই করে নেওয়া দরকার, তিনি আমায় সঠিক জীবন পথের সন্ধান দিতে পারবেন তো? গুরুর মধ্যে শিষ্যকে দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা ‘শক্তি’ থাকা দরকার নইলে, সেই শিষ্যের কোনো লাভ হয় না।
অনেকে ভাবেন, আমার গুরুদেব তো আর দেহ তে নেই। তিনি চলে গেছেন। এখন, অন্য গুরুর কাছে গেলেও অসুবিধা নেই।
অনেকে ভাবেন, আমার গুরুদেব নেই। আমি যদি, ওই ধারার অন্য কারোর কাছে যাই, অসুবিধা কোথায়? আমি যেটুকু জেনেছি তা হলো – গুরুর বিনাশ নেই, তিনি এক শক্তি, অবিনশ্বর। দেহান্তের পর সেই শক্তি আরো প্রকট হয়।প্রকৃত ভক্তকে সর্বদা ঘিরে রাখে সেই অবিনশ্বর শক্তি। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কখনো ভাববেন না, গুরু চলে গেছেন।
আসলে, গুরুর সঙ্গে যোগাযোগের পথ হলো, তার দেওয়া নামের জপ। যতক্ষণ আপনি জপ করবেন, গুরু আপনার সঙ্গে থাকবেন। প্রতি মুহুর্তে, জপের মধ্যে থাকলে, গুরু আপনাকে ছেড়ে যাবেন না।
প্রকৃত শিষ্যের প্রতি তিনি কখনো উদাসীন থাকেন না। তিনি দেহে থাকুন, বা না, থাকুন। আর নিজের গুরু নিজেরই গুরু। অন্যদের সম্মান দিয়ে, নিজের গুরুকেই মাথায় রাখতে হয়। অন্য ধর্ম বা অন্য গুরুদের নিন্দা করা যেমন অন্যায়, তেমনই অন্যায়, শুধু বেশভূষা দেখেই ‘গুরু’ ভেবে নেওয়া।
সদগুরু চেনার উপায় সম্পর্কে বাবাজী অনেক কথা বলেছিলেন, পরে সেই বিষয়গুলো আলোচনা করব।
আবার ফিরে আসি আশ্রমে।
শ্রীবাবাজীর মধ্যে শ্রীগীতার যে তিনটি অধ্যায়, জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, সেই তিনটি অধ্যায় হলো –জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ। বাকি যোগগুলি তিনি তার ক্ষুদ্র জীবনকালে পালন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, প্রকৃত সন্ন্যাসী বলতে কী বোঝায়?
ভোর যখন রাত্রির কোলে নিদ্রা যেত, যখন পাখিরাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, সমস্ত চরাচরে যখন শুধুই শান্তি, তখন শ্রীবাবাজী উঠে পড়তেন ঘুম থেকে। তখন ভোর তিনটে, আমাদের কাছে গভীর রাত। তিনি নিদ্রাভঙ্গের পর টিউবওয়েলে নিজের হাতে পাম্প করে কমুন্ডুলে জল তুলে স্নান করতেন। তারপর তুলীগাছে জল প্রদান করে তিলক-স্বরূপ করতেন। এরপর মঙ্গল আরতি। তখন ভোর চারটে। শীত-গ্রীষ্ম একই নিয়মে আবর্তিত হতো বাবাজীর দিনলিপি। পরবর্তী সময়ে শীতের সময় কিছুটা সময় এগিয়ে আনা হয়েছিল। এরপর শ্রীগীতা পাঠ।
আশ্রম তখন মুখর হয়ে থাকত শিশু-কিশোরদের কলরবে। গ্রামের শিশুরা হাজির হত। আশ্রমিক কিশো্ররাও সমবেত হত সেই গীতাপাঠচক্রে। গ্রামের মৃতুঞ্জয় বৈরাগ্যের ছেলে তীর্থনাথ বৈরাগ্য আর সুনীল বৈরাগ্যের ছেলে সোমনাথ(লালু) তখন আশ্রমেই বাবার কাছাকাছি থাকত। শুনেছিলাম, ওরা যখন ক্লাস ফোর-ফাইভে, তখন থেকেই বাবার কৃপালাভে ধন্য হয়েছিল। বাবাজী কোনদিন পড়াশোনায় অবহেলা পছন্দ করতেন না।
কারণ, তিনি জানতেন, একমাত্র শিক্ষাই আমাদের মুক্তি দিতে পারে দারিদ্র্য থেকে, কুসংষ্কার থেকে। আমাদের জীবনে চলার পথকে আরো সহজ করে দিতে পারে এই শিক্ষা।
তাই এখানে জড়ো হত গ্রামের বহু কিশোর ও শিশুরা। আসত শীতল বিশ্বাস, কৃষ্ণ হালদার, বরুণ বিশ্বাস, অরুণ বিশ্বাস, কার্তিক বৈরাগ্য, অরূপ ঘোষালরা। থাকতেন বিষ্ণুদাসজী ও রাধামাধবদাসজী।
ওদের মধ্যে দেখতাম ভক্তি আর কর্মের সমহার। আর আসতেন অমল বিশ্বাস। ছোটবেলা থেকে আশ্রমে তার যাতায়াত। বাবার আদেশ নির্বিচারে পালন করতেন। গ্রামের ছেলেরাও তার কথা শুনতো বলে জেনেছিলাম।
সেই সময় যারা আশ্রমে যেতেন, তাদের অনেকেই মনে রেখেছেন তোতাকে। ও প্রতিদিন ফুল তুলে হাজির হয়ে যেত আশ্রমে। একেবারে নিয়মমেনে।
আসতেন তোতার দাদু নীহাররঞ্জন ব্যানার্জী।
গীতাপাঠদান শেষে ছেলেরা ফিরে যেত বাড়িতে। স্কুলের পড়া তৈরি, তারপর স্কুলে যাওয়ার তাগিদ ছিল। এরপর শ্রীবাবাজী কিছু মুড়ি সেবা করে জপএ বসতেন। সকাল ৯ টায় পুজোপাঠ। এক নিষ্ঠা আর কর্মের প্রবাহ তখন আশ্রম জুড়ে। যার কোনো ছেদ দেখিনি।
আগামিকাল...