No title

কিন্তু তিনিই তো ব্রম্ভা, তিনিই তো বিষ্ণু, তিনি তো মহেশ্বর – তাই তার কাছে কোনো কিছুই অজানা নয়। সকলের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে থাকলেন। তার পাঠের মধ্য থেকেই উঠে আসতে লাগলো মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর। 

এমনকি, আমি যে প্রশ্নগুলো বাবাকে রাতের বেলা করবো বলে ভেবে রেখেছিলাম, সেগুলোর আলোচনাও শুনলাম। একের পর এক প্রশ্ন 
‘আমি কে?’ 
মনুষ্য জীবনে আমাদের লক্ষ্য কী?’ 
‘সংসারে আমাদের কর্তব্য কী?’ 
‘সদগুরু কে?’ 
‘শিষ্যের করণীয় কী?’ ‘
ঈশ্বরপ্রাপ্তি কখন হয়?’ এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন, সব এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। যারা শ্রীবাবাজীর প্রবচন শুনেছেন, তারা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন। তবে, এগুলো আমার জীবনে সেই মুহুর্তে প্রথম শোনা। শ্রীবাবাজীর বলা এই প্রশ্নগুলো আমার মনের মধ্যে একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেল। আর সেই দিনই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিলাম। 


ঈশ্বরপ্রাপ্তি কখন হয়, তা বোঝাতে গিয়ে উনি একটা গল্পের আশ্রয় নিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের বলা একটি গল্প। আমি এখানে সেটা লিখছি – 
একবার এক সাধুজী আর তার চেলা নদীতে স্নান করতে নেমেছেন। এমন সময় চেলা তার গুরুদেবের কাছে জানতে চাইল, সে কখন ঈশ্বরকে পাবে। সেই সাধুজী তৎক্ষণাৎ সেই শিষ্যকে টিপে ধরলেন জলের ভিতরে। 
শিষ্য তো শ্বাস নিতে না পেরে খাবি খেতে লাগলো। তারপর, হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রাণপণ চেষ্টায় কোনরকমে জল থেকে বের হতে পারলো। 
এবার গুরুজী তার দিকে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি রে, কেমন লাগছিল?’ 
শিষ্য বড়ো একটা শ্বাস টেনে বলে, ‘প্রাণটা যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল আর বাতাসের জন্য বুকের ভিতরটা হাঁকপাঁক করছিল।‘ 
সাধুজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ আমাদের যখন এমন অবস্থা হবে যে ঈশ্বরকে না পেলে আর বাঁচবো না, তখনই তাকে পাওয়া যায়।‘


 সেদিনের মতো পাঠ শেষ। আমরা সে রাতে প্রসাদ পাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত বাবার ঘরে ছিলাম। তার প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। 
লোহাকে যেমন চুম্বক আকর্ষণ করে, ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর যেমন সবকিছু, এমনকি আলোক-রশ্মিকেও শোষণ করে নেয়, ঠিক সেই রকম এক অত্যাশ্চর্য আকর্ষণ। আসলে সদগুরু এমনই হন। গুরু অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সদগুরু পাওয়া সহজ নয়। মা যেমন তার নোংরা-মাখা ছেলেকে নোংরা থেকে তুলে, সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে নেন, তারপর তাকে নিয়ে বেড়াতে বা মন্দিরে যান – সদগুরুও তেমনই। তিনি আমাদের চিত্তের নোংরা সাফ করে আপন করে নেন।
 বকেন, মারেন- আবার ভালোওবাসেন। পদে পদে পরীক্ষা নেন। শিষ্য যদি সফল হয়, ভালো। আর না হলে, যতক্ষণ না সফল হয়, ততক্ষণ বা ততদিন সদগুরু তার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। শিষ্যের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে পারে, কিন্তু সদগুরু থাকেন অবিচল। 
সদগুরু নৌকায় একবার পা দিলে, তিনি আপনাকে পার করবেনই। সংসারের হাজারো চাপে, শিষ্য যদি জপ-ধ্যান করতে নাও পারে, সদগুরু সেই শিষ্যের হয়ে তাও করে দেন। যেদিন তিনি মন্ত্র দেন, সেদিন থেকেই শিষ্যের সব ভার গিয়ে পরে তার উপর। তার ইহকাল, এমনকি, তার পরকালের ভারও। তাই শিষ্যের এমন কিছু করা উচিত নয়, যার জন্য সদগুরু কষ্ট পান। 


আমরা এরপ শুতে গেলাম। আশ্রম তখন শান্ত। এক অপূর্ব শান্তির পরিবেশ। পরের দিন ঘুম ভাঙলো ঘন্টার শব্দে। তখন ভোর চারটে। আরতি শুরু। ইতিমধ্যে গ্রামের বাচ্চারা হাতে টর্চ কিংবা হ্যারিকেন নিয়ে আশ্রমে আসতে শুরু করেছে। সবার হাতে একটা করে গীতা। 
আমি একটু আশ্চর্য হলাম। পরে দেখলাম, বাবা সবাইকে গীতার শ্লোক পড়ালেন, মানে বুঝিয়ে বুঝিয়ে। তারপর আগের দিনের শ্লোক ও তার মানে প্রত্যেককে দিয়ে বলালেন। যার যার বলা হয়ে গেল, তাদের প্রত্যেককে লজেন্স দিলেন। শিশুরা, তাদের গীতাপোদেশদানকারী ভগবানকে প্রণাম করে যার যার বাড়িতে ফিরে গেল। 
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কতো পূণ্য করলে এই নতুনগ্রামে শিষ্য হয়ে জন্মানো যায়। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেন তার ভক্তদের কাছে গীতার বাণী শোনাতে আবার এই ধরাধামে এসেছেন।
 

রাধামাধজীর সঙ্গে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরলাম। তারপর স্নান সেরে রাধামাধজীর দেওয়া একটা নতুন ধুতি পরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সকাল ৯ টায় বাবা আমাকে ডাকবেন- সেই ডাক শোনার জন্য। রাধামাধবজী কয়েকটা টগর ফুল তুলে এনে একটা থালায় রাখলেন, ৫ টা ফল রেখে বললেন, মন্ত্র নেওয়া হয়ে গেলে, ওগুলো বাবাজীকে অর্পণ করতে। 
ঘড়ির কাটা ৯ টা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার জপের ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উনি বললেন, ‘পার্থ, ভিতরে আয়।‘ 
ভিতরে গেলাম। সেদিন আমার মন্ত্র হলো। সেদিন ঘরের ভিতরের সেই অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্বল। সেইদিন আমার মতো এক অধমকে শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া মহারাজজী শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেন। হয়তো, আমার পূর্বজন্মের কোনো পূণ্য ছিল, তাই তার করুণা পেলাম। আমাকে দীক্ষা দেওয়ার পর বাবা আবার জপের ঘরে চলে গেলেন। 


সেদিনও আরতি দেখলাম, প্রসাদ পেলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা। শ্রীবাবাজীকে আগেই জানানো ছিল যে আমাদের ফিরতে হবে। ওনার ঘরে ঢুকলাম অনুমতি নিতে। 
উনি বললেন, ‘বড্ড কম সময় তোরা রইলি, আবার কবে আসবি? গুরুপূর্ণিমায় আসবি তো?’ 
এমনভাবে বললেন যেন এক পরমাত্মীয়। নিজের কোনো আত্মীয়-স্বজনও এভাবে অযান্ত্রিকভাবে বলতে পারে না। টিভি সিরিয়ালের যুগে মানুষ মানুষের বাড়ি গেলে কথা বলবার সুযোগ পায়না। বাবার কথার উত্তরে আমরা সবাই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। তবে, একমাত্র আমি মনে মনে জানি, আমার আর কোনদিন এই আশ্রমে হবে কি না, সেটা অনিশ্চিত। কতো বাধা অতিক্রম করে এবারে এসেছি, সেটা একমাত্র অন্তর্যামী স্বয়ং জানেন।

 আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad