ছদ্মবেশী ‘গুরু’রা যাতে আপনার পারমার্থিক ক্ষতি করতে না পারেন, সেজন্যই বাবাজী মহারাজ গুরু চিনে নিতে বলতেন
তারক ঘোষ
পর্ব ২৪
গতকাল ভারতের নামী-দামী ইংরাজী ও হিন্দি সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটা হল,- রাজস্থানের হনুমানজী মন্দিরের এক ধর্মগুরু তথা মহন্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও তার মায়ের উপর এসিড ছোঁড়ার অভিযোগে।
এই ধরণের খবর মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়। কাম ও অর্থের নেশায় ছুটে চলা তথাকথিত কিছু ‘ধর্মগুরু’ এই ধরণের কর্মে লিপ্ত হন। এই বিষয়ে যা বলার মহামান্য আদালত বলবে। আমার যেটা বলার সেটা হল, ধর্মের অঙ্গনে থেকে নিজেকে ধর্মগুরু সাজিয়ে, মহন্ত পদ অলঙ্কৃত করে যারা এই ধরণের পাপ ও আইনগত অপরাধ করে থাকেন, তারা শুধু সাধু সমাজের অসম্মান করেন না, কলঙ্কিত করেন ধর্মীয় পরিবেশকে, ক্ষতি করেন সনাতন ধর্মের। আর আঘাত করেন সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে।
সাধু বলতে যারা ঈশ্বরের কাছাকাছি থাকা মহাত্মাকে বোঝেন, তারা যখন এই ধরণের কামাচারী পুরুষদের দেখেন, যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে মহিলাদের ইজ্জত ও ভক্তদের অর্থ হরণ করেন, তখন কী মনে হয়? আপনার যাই মনে হোক, একটা কথা জেনে রাখুন, এদের সংখ্যা খুব কম। এরা যোগীর ছদ্মবেশে ভোগী।
যারা কাম জয় করতে পারেন নি, তাদের কাছে মহিলারা ভোগের বস্তু হিসাবেই থেকে যায়। এরা ভক্ত চেনেন না, শুধু চেনেন অর্থ ও কাম। কাজেই এরা সাধু নামে অযোগ্য, সমাজের কলঙ্ক, মহন্ত পদের লজ্জা।
তাই একটি কথা বলার আছে, এই ধরণের ছদ্মবেশী ‘গুরু’রা যাতে কোন ক্ষতি করতে না পারেন, বা আপনাকে লুটে নিতে না পারেন, সেজন্যই বাবাজী মহারাজ গুরু চিনে নিতে বলতেন। গুরুকে যাচাই করার কথা বলতেন। গুরু যদি সমদর্শী না হন, গুরু যদি নিজেই অর্থের পিছনে দৌড়ান, গুরু যদি ধনী শিষ্যকেই গুরুত্ব দেন, গুরু যদি নিজেই অর্থ ও কামনার দাস হন, তাহলে তিনি কখনই কৃষ্ণের দাস হতে পারবেন না। এই সমস্ত গুরুরা ভক্তের চেয়েও নিজেদের ক্ষতি করেন বেশি। এদের হাতে পড়ে ভক্তদের যতটা ক্ষতি না হয়, বেশি ক্ষতি হয় তাদের। কারণ, সনাতন ধর্ম এতো ঠুনকো নয় যে, এই ধরণের দু-চার জন কামাচারী অর্থলোভী ‘গুরু’দের জন্য ভেঙ্গে পড়বে। তবে, প্রথমেই সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো।
এই প্রসঙ্গে, মহন্ত মহারাজ সন্তদাসজী রচিত শ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া মহারাজের জীবনচরিত থেকে একটি অংশ বলি। যেখানে আমরা জানতে পারি, একজন প্রকৃত সাধু কীভাবে কাম ভাবকে দেখেন। ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া মহারাজ ছিলেন যোগীরাজ। তিনি, এই শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে মানুষের বিশ্বাসে আঘাত লাগে, এমন কাজ গুরুরা না করেন। কারণ, গুরু শিক্ষক। তার আদর্শ শিষ্যরা মেনে চলেন।
কিন্তু, তিনি যদি সর্বসমক্ষে এক ভাব দেখান, আর গোপনে অন্য ভাব, তাহলে, তারা নিজেদের ঠকান। তাদের জন্য ঈশ্বরের বিচারতো থাকছেই, তারও আগে পার্থিব আদালতের দরজাও খোলা। আর একটি কথা, ঈশ্বর সবকিছু দেখেন। তিনি নিজে আবির্ভূত না হয়ে, অন্য মানুষের মাধ্যমে, সেই কামাচারীকে ধরিয়ে দেন।
“তখন স্ত্রীলোকটি অতিশয় ভীতা হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, ‘মহারাজ! আমাকে ক্ষমা কর, আমার কোন দোষ নাই, ব্রজবাসীগণ তোমাকে পরীক্ষা করিবার জন্য আমাকে তোমার নিকট পাঠাইয়াছে, তাহাতেই আমি তোমার নিকট আসিয়াছি। আমাকে ক্ষমা কর।‘
তখন তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা চলা যা, ঔর সাধুকা পাশ ইস মাফিক কভি নাহি যানা, সব সাধু বরাব্বর নহি হোতা হ্যায়, কোই যোগীরাজ ভি হ্যায়।‘
বাবাজী মহারাজ আর একটি কথা বলতেন। এই কথাগুলি তার জীবনীগ্রন্থে সঙ্কলন করেছেন তার সাধু শিষ্য স্বামী সদগুরুদাসজী। বাবাজী মহারাজ বলতেন – “যে সাধুজী সব ছাড়িয়া শিষ্য-শিষ্যাদের পূজা পাইতে পাইতে অসার স্তোক বাক্য শুনিতে শুনিতে নিজেকে ঈশ্বর ভাবিয়া ঈশ্বরকে ভুলিয়াছে, হায়! সে কে করিয়া আবার এই অসার সুখ ছাড়িবে।“
বাবাজী ত্যাগব্রতের কথা বলতেন, বলতেন আশ্রমের পবিত্রতা রক্ষার কথা। তার জীবনীগ্রন্থে দেখতে পাই, তিনি বলেছেন –“আমাদের আশ্রমগুলি যেন যথার্থ অর্থেই ভজন সাধনের তথা লোক কল্যান তথা শাস্ত্র প্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়। যেখানে একদিকে ত্যাগব্রতী সাধুদের জীবন দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া উদভ্রান্ত যুবক শ্রেণি, অপরদিকে সীতা-সাবিত্রী, লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি নারীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া ভারতে নারী সমাজ নূতন করিয়া আত্মমূল্যান করিবে এবং ইহাদের হাত ধরিয়া নূতন ভারত গড়িয়া উঠিবে।“
এই হলেন আমাদের বাবাজী মহারাজ, যিনি স্বপ্ন দেখতেন, সাধু সমাজ যেন আশ্রমে থেকে অর্থ উপার্জন বা ধনী শিষ্য বাড়ানোর দিকে মন না দেন। বরং, সাধু সমাজের দেখানো সঠিক পথে নূতন ভারত যাতে গড়ে ওঠে সেই স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি সাম্যের কথা বার বার বলতেন।
আমার মনে আছে, আমি বাবার কাছ থেকে যে তিনটি বই প্রথম পাই, তার একটি হল ‘A Society In The Thought Of Marx And Nimbarka’ প্রথম দিন বাবা রাধামাধবকে ডেকে বললেন, “রাধামাধব, যা, তারককে আমার কয়েকটা বই এনে দে।“
রাধামাধবের হাত থেকে যে বইগুলো সেদিন নিয়েছিলাম, তার দ্বিতীয় বইটি হল স্বামী রামদাসজী কাঠিয়া বাবার জীবন চরিত ও তৃতীয় বইটি হল ‘জীবন পথের পাথেয়’।
পরবর্তী সময়ে বাবার লেখা সব বই পেয়েছি। এমনকি, জীবনের শেষ পর্যায়ে স্বামী বিষ্ণুদাসজী আমায় দিয়ে গেছেন, বাবাজীর ইংরাজী গীতা চিরন্তন। আর স্বামী সদগুরুদাসজীর কাছ থেকে পেয়েছি দুটি গ্রন্থ। একটি ‘প্রবন্ধ পারিজাত সৌরভ’, অন্যটি বাবাজী মহারাজের জীবন চরিত।
স্বামী রাধামাধব দাসের কাছ থেকে পেয়েছি ‘একটি করুণ ইতিহাস’, আর বাবাজী মহারাজের বেশ কিছু দূর্লভ ছবি। অন্যদিকে, স্বামী সদগুরুদাসজী দিয়েছেন, বাবার বেশ কিছু প্রবচনের ভিডিও।
আমার সম্বল বলতে এই মহামূল্যবান পুস্তক ও ভিডিওগুলি। বাবাজীর আশির্বাদ এই গ্রন্থগুলি। এটাই আমার গর্বের সম্পদ। আর এর উপর নির্ভর করেই আমার এগিয়ে চলা। বাবাজীর সামনে বসে, যেটুকু শুনেছি, সেটুকু আপনাদের সামনে বলার চেষ্টা করছি, এর সঙ্গে আমার বিশ্লেষণ।
আমি জানিনা, আপনারা এই লেখা পড়েন কি না, কিন্তু আমি লিখে যাই, কেননা, আমি সেই অর্থবান ভক্ত নই যে ইচ্ছা করলেই বাবার নামে একটা মন্দির বানিয়ে ফেলবো।
তবু, ভাবি, যদি বাবাজীর নামে কোন ধ্যানকেন্দ্র ও গীতা পাঠচক্র গড়ে তোলা যেত। মানুষ সেখানে এসে বাবাজীর বাণী শুনতেন, তার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতেন।
বাদ দিন ওসব কথা।
বাবাজীর দুটি কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। একটি হল – সমদর্শি ও অন্যটি শ্মশান বৈরাগ্য।
বাবাজী মহারাজ তার ‘সাম্য’ প্রবন্ধে লিখছেন – “মার্ক্সীয় সমাজ রূপান্তরের ধারণাটি একটি Journey – Real manship থেকে True Manship এর দিকে। The transformation of human society through dialectical materialism and class struggle is nothing but transformation of Real manship to a True manship.
(দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে মানব সমাজের রূপান্তর বাস্তব মনুষ্যত্বের থেকে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। এই True man রা সমাজের অঙ্গস্বরূপ। Human being is nothing but an organ of human society. (। মানুষ মানব সমাজের অঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। ) এখানে ব্যক্তিস্বার্থ সমাজের সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে গেছে এবং ভাবা হয়েছে, এই অবস্থায় উপনীত হলে মানুষ সমাজের কল্যাণ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না।
To serve the society will be the habit of common people in communist society. (সমাজের সেবা করা কমিউনিস্ট সমাজে সাধারণ মানুষের অভ্যাস হয়ে যাবে।)
এরপর সোমবার