শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২২

ভগবান কাউকে ঠকান না, ভগবানের দোহাই দিয়ে কিছু মানুষই মানুষকে ঠকায় 

তারক ঘোষ 

পর্ব ২২

 বাবাজী মহারাজ তার “নিম্বার্ক দর্শনে শিক্ষা’ প্রবন্ধে লিখছেন – “ ভগবানকে বাদ দিয়ে কেবল ইন্দ্রিয়ভোগের মাধ্যমে শান্তি পাওয়া যায় না। জগতকে তাচ্ছিল্য করায় আমরা নিঃস্ব হয়েছিলাম। এখন ধর্মকে বাদ দিয়ে আমরা উচ্ছৃঙ্খল হলাম। ব্রম্ভ মিথ্যা, জগত সত্য ভাবলে অর্থাৎ ভগবান নাই, জগৎটাই সব – এই ভাবনা দীর্ঘদিন ভারতের মাটিতে কাজ করেছে। 
শ্রীনিম্বার্কাচার্য্য শঙ্করাচার্য্যের বহু আগেই বলে গেছেন ‘ ব্রম্ভ সত্য, জগৎও সত্য। জগতকেও বাদ দেওয়া যাবে না, আবার ভগবানকেও বাদ দেওয়া যাবে না। পরাবিদ্যার জন্য অপরাবিদ্যার দরকার, কিন্তু মনে রাখতে হবে শ্রীভগবানকে লাভ করার জন্য জাগতিক বিদ্যার দরকার।“ 
বাবাজী লিখছেন, “আজ হয়েছে উলটো। বৈষয়িক উন্নতির জন্যই আজ আমরা ভগবানকে ডাকি। আসলে জীবনের মূল লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। সেই ঈশ্বরকে পেতে হলে আহার, বস্ত্র এবং বাসস্থানের দরকার।“ নিষ্কাম কর্ম সম্পর্কে তিনি লিখছেন, “নিষ্কাম কর্মযোগ হল নিজের জন্য কিছু না চেয়ে কেবল পরের জন্য কর্ম করা।“ 
এই প্রসঙ্গে কবি বলে গেছেন – 
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে 
 আসে নাই কেহ অবনী পরে, 
সকলের তরে সকলে আমরা 
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।“
  

বেঁচে থাকার জন্য রোটি, কাপড়া আউর মকান কি জরুরৎ হ্যায়। প্রত্যেকের মধ্যেই ক্ষিদে আছে। তিনি সাধুই হোন, বা গৃহীই হোন। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান – তাই মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন। 
কিন্তু, আজ আমরা কী দেখছি! যার বেশি আছে, সে আরও বেশি চাইছে। একটা গাড়ি, একটা নারী বা একটা বাড়িতে কেউ সন্তুষ্ট নয়। অন্যায়ভাবে নিজের প্রয়োজনের লক্ষ্গুণ সে সংগ্রহ করছে। যে উপার্জনের একটা বিরাট অংশ বেআইনি, কালো টাকার পাহাড় জমছে। সেই টাকা বাজারে আসে না, সেই টাকার কোন হিসাব নেই, ফলে সাধারণ মানুষের উপর ঋণের বোঝা চাপছে। 


বদলে যাচ্ছে আশ্রমের চেহারা। ঝাঁ চকচকে আশ্রমে ঢুকতে গেলে পরিচয়পত্র লাগে, আশ্রমের সদস্য কি না, তার প্রমান লাগে, প্রসাদ পেতে পয়সা লাগে। ভক্ত নয়, গুরু নয় – সবটাই চলছে করপোরেট ম্যানেজমেন্টের তত্ব দিয়ে। 
এক একটা আশ্রম হয়ে উঠছে অর্থের খনি, বাড়ছে লোভ, বাড়ছে অন্যায়, বাড়ছে আশ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্ধ। বহু জায়গায় মহিলাদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করা হচ্ছে। এক শ্রেণির ‘ধর্মগুরুরা’ শিশু-কিশোরীদের ধর্ষণের দায়ে জেলে যাচ্ছেন। কোন কোন মঠে ধর্মীয় পদাধিকারীরা আত্মহত্যা করছেন। এরকম খবর আমরা প্রায়ই দেখছি খবরের কাগজ, কিংবা টিভিতে। 
এটাই কি সেই ধর্ম, যা আমরা মনের মধ্যে লালন করে, হৃদয় দিয়ে পালন করে এক সনাতন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখছি। অনেকে বলবেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একেবারে সত্যি, এখনো ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে তবু চলে যাচ্ছে, কিন্তু এই ঘটনা যদি ‘মহামারীর’ রূপ নেয়, তাহলেই শেষ। 


বাবাজী বলতেন, শ্রীজানকীদাসজীও লিখেছেন – ‘পদ আর অর্থের লোভ সাধকের সবচেয়ে ক্ষতি করে।‘ আমি তাদের বলে যাওয়া কথা আর চারিদিকের অবস্থার মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাই। অনেকেই জানেন, পদ এর মোহকে কেন্দ্র করে গোপনে কতো রক্ত ঝরে সাধকদের মধ্যে। 
আশ্রমের পরিধি বিস্তার হলে, বেনোজল ঢোকে। কালো টাকা দান করে বহু ‘সুযোগসন্ধানী ভক্ত’ তাদের আখের গোছানোর চেষ্টা করে। যে আশ্রম ভক্তি আর ভালোবাসায় গড়ে ওঠে, সেই আশ্রম ছেড়ে পালানোর জন্য প্রকৃত সাধকের প্রাণ তখন ছটফট করে।
 আমি দেখেছি এমন কিছু ‘গুরুদেব’ আছেন, যারা দরিদ্র শিষ্যদের বাড়িতে যেতে চান না। ধনী শিষ্যদের ঘরেই আতিথ্য নেন। হয়তো ‘কৃপা’ করে কয়েক মিনিটের জন্য গরীব শিষ্যদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়ে তাদের কৃতার্থ করেন। অথচ, এরা ধনী শিষ্যদের বাড়িতে এক বা দু-তিনদিন অনায়াসে কাটিয়ে যান। অথচ, দেখা যায়, তিনি তার ধনী ও গরীব উভয় শিষ্যকেই একই মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছেন। 
তাহলে, মন্ত্রের ক্ষেত্রে যখন পার্থক্য নেই, আচরণে কেন এই পার্থক্য?


 বাবাজী বলতেন, “সাধু হওয়া খুব কঠিন। আর সাধুর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো লোভ।“
 তিনি ‘একটি করুণ ইতিহাস’ পুস্তিকায় লিখছেন – “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন এইরূপ অসৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তখন তিনি তাহা ধ্বংস করিয়া গিয়াছিলেন। নিজের ইচ্ছায় নিজের যদুবংশ তিনি ধ্বংস করিয়া গিয়াছেন। যে পশুতার বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন লড়াই করিয়া গিয়াছেন, মানুষ শেষে তাহাকেই পশু ভাবিয়াই হত্যা করিয়াছে। সেই সময়ও হাসিতে হাসিতে বলিয়া গিয়েছেন দারুককে – ‘সকলের কল্যাণ যদি তুমি করিতে চাও এবং করিতে থাক তবে তুমিও মনে মনে তৈরি থাক তোমার শেষ পরিণতি এইরূপই হইবে। তবুও আদর্শকে ছাড়িও না। ইহাই নিষ্কাম কর্মযোগ।“ 


বাবাজী মহারাজ বারবার এই আদর্শের কথাই বলতেন। গল্পের মাধ্যমে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করতেন, লোভ আর কাম কতো খারাপ জিনিষ। এই দুই এর দাস হলে, জীবন কত ভয়ঙ্কর হয়, তার উদাহরণও তিনি দিতেন। 
আপনারা একটু বাইরে তাকিয়ে দেখুন। প্রায় প্রতিদিন নারী ধর্ষিতা হচ্ছে। যুবতী, তরুণী, কিশোরী নয়, শিশুরাও আজ ধর্ষণের শিকার। প্রেমিকাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হচ্ছে। গলা কেটে বউকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে নদীতে। কেন এসব? সামাজিক অবক্ষয়? ব্যক্তিগত অবক্ষয়? না কি, মানবিক অবক্ষয়? ঈশ্বরত্বের সাধনা তো দূরের কথা, আমরা মানবতার সাধনাও ভুলেছি।


 বাবাজী মহারাজ বলি প্রথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, পশুকে বলি নয়, নিজের মধ্যে যে পশুটা রয়েছে, তাকে বলি দিতে হবে। আজ এক শ্রেণির মানুষ সেই পশুত্বের দাস হয়ে গেছেন। বাইরের আবরণের ভিতরে রয়ে গেছে সেই আদিম প্রবৃত্তি। এই আদিমতা থেকে মুক্তি দেওয়ার কথাই ভেবেছিলেন আমাদের শ্রী গুরুদেব ডক্টর স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজী।
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad