শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ১১

গুরু-শক্তি ধারণের জন্য প্রয়োজন হয় এক সৎ আধারের, যে সে সেটা পায়না

রের দিন ১৪ চৈত্র। আমাদের ফিরে যাওয়ার দিন। আমার স্ত্রী বাবার কাছে অনুমতি আনতে গেছেন। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি আমবাগান। আমের বকুলে গুটি হয়েছে। মিষ্টি গন্ধ। গ্রীষ্মের সব রুক্ষতা ঘুচে যায় কোকিলের কন্ঠের সুমধুর আওয়াজে। মনে হয়, আশ্রমে গ্রীষ্ম নয়, বসন্ত, চির বসন্তে ছেয়ে আছে আশ্রম। 

ঘুরতে ঘুরতে আশ্রমের বাইরে এলাম। তাঁত চলার ঠক ঠক শব্দ। একজনের বাড়িতে ঢুকলাম। মাটির বাড়ি। মাটির ঘরে তাঁত চলছে, বোনা হচ্ছে কাপড়। সরু সরু সুতো মিলে মিশে তৈরি করে ফেলছে এক বর্ণময় কাপড়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। 
এ যেন কাপড় নয়, বোনা হচ্ছে আমাদের জীবন। ছোট্ট ছোট্ট অভিজ্ঞতার সুতো দিয়ে স্মৃতির তাঁতে বোনা হচ্ছে আমাদের জীবন। বোনা শেষ হলে পূর্ণতা পাবে সেই জীবন। আর এই জীবনের কাপড় যিনি বুনছেন, তিনি হলেন পরমেশ্বর, আমার গুরু। আমাদের গড়ে নিচ্ছেন নিজের সব ভালোটুকু দিয়ে। আমাদের কষ্ট, শোক হয়, আমরা তার নিয়মে চলতে পারিনা বলে। যদি পারতাম, তাহলে সেই জীবন রূপ কাপড়ের রঙ কোনদিনই ফিকে হতো না। 
কাপড় বুনতে বুনতে ওই তাঁতি ভদ্রলোক বললেন, “প্রথম এলেন?” 
মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম। 
দীক্ষা হলো? বললাম, নিলাম। 
বাঃ বাঃ তিনি এবার তাত থামিয়ে বললেন, “এই গ্রামটা উনি আসার পর বদলে গেছে। আমাদের জীবনে একটা ভরসা এসেছে।“ 
 আমি চুপ করে শুনছি। উনি বলে চলছেন, জানেন, “আমরা ওনাকে ভীষণ মানি। উনি মানুষ নন, দেবতা। আমাদের এই গ্রামটা এখন বৃন্দাবন হয়ে উঠেছে।“ 


আমি যখন আশ্রমে ফিরে এলাম, তখন প্রসাদ দেওয়া চলছে। শ্রীরাধারাণীর মন্দিরের সামনের চাতালে দু-ধারে প্রসাদ পাওয়ার ব্যবস্থা। রাধামাধবকে লক্ষ্য পড়লো। ওকে দেখে আশ্চর্্যি হয়ে যাই। সকালে ওকে দেখেছিলাম, দাদাজীর সমাধি মন্দিরের কাছাকাছি একটা মাঠে কাজ করছে, এখন ভক্তদের প্রসাদের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। প্রসাদ পেতে বসলাম। 
আমার স্ত্রী বললেন, “বাবাজী অনুমতি দিয়েছেন।“ 
প্রসাদ পাওয়া শেষে, আমবাগানে মেয়েকে নিয়ে সব দেখাচ্ছিলাম। 
স্ত্রী বললেন, “বাবা বলছিলেন, থেকে গেলে হয় না? আমি বাবাকে বললাম, ওর কাজ আছে। তবে, এখান থেকে চলে যেতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। শুনে, বাবা কী বললেন জানো?” 
আমি অধীর আগ্রহে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী বললেন উনি?” 
আমার স্ত্রী বললেন,”তোর কষ্ট হয়, আমার কষ্ট হয় না রে!” আমার স্ত্রীর চোখে জল। 
বললেন, “ঠিক মনে হচ্ছে, নিজের বাপের বাড়ি থেকে যাচ্ছি।“ 


আমাদের গুরুদেব এই রকম ছিলেন। নিজের পিতার মতো, শিক্ষকের মতো, ভগবানের মতো। যার উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে, জীবনের সব কষ্ট-দুঃখ আর গায়ে লাগে না। সেদিন ফিরে এসেছিলাম। রেখে এসেছিলাম আমার চেতনাকে, আমার সব ভক্তিকে। 
আমি এমন একজন মানুষ, যে বাহ্যিক আচারে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু, কী একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। আমার উগ্রতা যেন কমে আসছিল। জীবনের নিরাপত্তাহীনতা হারিয়ে গিয়ে জন্ম নিচ্ছিল, এক শক্তিশালী নিরাপত্তার। তিনি তো সত্যিই সদগুরু। যিনি আমার চেতনাকে মিশিয়ে দিতে পারেন নিজের চেতনার সঙ্গে। সদগুরুই তো ভগবান। 


আমি তত্ব বুঝি না, জ্ঞান বুঝি না, বেদ-বেদান্ত বুঝি না, আমি বুঝি গুরু তৃপ্ত হলে সব পাওয়া যায়। গুরু-বাক্যকে অগ্রাহ্য করে শান্তি মেলে না। আমরা যাকে বাস্তবে দেখছি, তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ। কিন্তু, সেই দেহের মধ্যে যিনি আছেন, তিনিই গুরু-শক্তি, যা এক গুরু থেকে আরেক গুরুতে সঞ্চারিত হয়। আমার মনে হয়, এই গুরুশক্তি ধারণের জন্য দরকার হয়, এক পূণ্যের আধার। 
সব শিষ্যই গুরুশক্তি ধারণ করতে পারেন না। কারণ, গুরু-শক্তি ঈশ্বরের এক রূপ, যে সে সেটা পায় না। আগামিকাল..



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad