শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২৫

‘ত্যাগ’ শব্দটা বলা সহজ, কিন্তু করা সহজ নয় 

তারক ঘোষ

পর্ব ২৫

 এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ কী? এই প্রশ্নটা করা হলে, অনেকে অনেক রকম উত্তর দেবেন। কেউ বলবেন – অহঙ্কার, কেউ বলবেন – লোভ, কেউ বলবেন – কাম। কেউ বলবেন – অর্থ। 
প্রত্যেকের উত্তরের পিছনে যুক্তি আছে। আর যারা, এই উত্তরগুলো দেন, তাদের কাছে ওই বিষয়গুলো ত্যাগ করা সত্যিই কঠিন। 
কিন্তু, বাবাজী মহারাজ বলতেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ ‘আমিত্ব’ কে ত্যাগ করা। নিজের মধ্যে যে ‘আমি’ বোধটা লুকিয়ে আছে, সেটাকে ত্যাগ করা খুবই কঠিন। আর যিনি সেটা ত্যাগ করতে পেরেছেন, বা ‘আমি’কে ‘তুমি’তে বদলাতে পেরেছেন, তিনি ভগবানের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। 
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও এই ‘আমি’ কে ত্যাগ করার কথা নানা লোক-কথার মাধ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। 

কিন্তু, কী এই আমিত্ব? ‘আমিত্ব হল সবচেয়ে বড় অহঙ্কার।
 ‘আমি করেছি, আমি রয়েছি তোমার জন্য, আমি থাকতে তোর কেউ কিছু করতে পারবে না, আমি এই বিশাল সম্পদ তৈরি করেছি’ – এই যে ‘আমি’ বোধ, এটাই ‘আমিত্বের অহঙ্কার’। কিন্তু, ‘আমি’ কি সব পারে? সে তার মৃত্যুকে রোধ করতে পারে? যদি না পারে, তাহলে এই ‘আমি’ সর্বশক্তিমান নয়। 
কাজেই যিনি সর্বশক্তিমান, তাকেই নিজের মনের মন্দিরে বসাই। আচ্ছা, যখন ভালো কাজ করেন, তখন ‘আমি’ বোধটা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনের মধ্যে বেশ ফুরুফুরে হাওয়া বইতে থাকে। 
নিজের বিশাল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মনটা একইসঙ্গে আনন্দে আর অহঙ্কারে ভরে ওঠে, তাই না? কিন্তু, যখন সেই ‘আমি’ কোন খারাপ কাজ করে, এমনকি আদালতের দোরগোড়ায় টেনে নিয়ে যায়, তখন, কেন বলেন, সব ভগবানের দোষ, কিংবা ভাগ্যের দোষ?


 বাবাজী মহারাজ, অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন ‘তুমিত্ব’বাদে। আর একটি আমিত্বে বিশ্বাস করতেন - সেটি হল সূক্ষ 'আমি' - সদ, আনন্দস্বরূপ।  সকলকে তাই বলতেন, যদি ত্যাগ করতে হয়, তাহলে তোর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘স্থুল  আমিত্ব’ টাকেই আগে ত্যাগ কর। দেখবি সব অহঙ্কার কোথায় চলে যাবে।
 যে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আজ মন ভরে যাচ্ছে, মনের মধ্যে ‘আমি করেছি’ বলে অহঙ্কার হচ্ছে, সেই বাড়ির দরজা দিয়েই তোকে একদিন চলে যেতে হবে চিরকালের জন্য। বাড়িটার মালিকানাও বদলে যাবে। একদিন সেই সাধের বাড়িটাও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। যেখানে তোর নিজের দেহটার মালিক তুই নয়, সেখানে কিসের আমিত্ব? 
কাজেই ত্যাগ, অতি কঠিন বস্তু আর ‘আমিত্ব’ ত্যাগ আরো কঠিন। বাবাজী নিজে কোনদিন বলতেন না, ‘আমি দেখছি, আমি আশির্বাদ করছি, আমি আছি তোর জন্য।‘ 


বাবাজীকে ভক্তরা যখন বলতেন, বাবা, ছেলেটার কিছুতেই শরীরটা সারছে না, আপনি ওকে আশির্বাদ করুন, যাতে সুস্থ হয়ে যায়। বাবাজী বলতেন, আমি ভগবানের কাছে নিবেদন করব। আসলে, ‘আমি’র একটাই কাজ, ভগবানের কাছে  সবকিছু নিবেদন করা। বাকিটা তিনি করবেন। 
কর্ম করা, কিন্তু ফল তাকেই অর্পণ করা। কিন্তু মনে রাখতে হয়, ঈশ্বর সেই ব্যক্তির কর্মফল, তাকেই ফিরিয়ে দেন। কাজেই মনে রাখবেন, কোন ধরণের কর্ম আপনি করবেন, কারণ, ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত ‘ফল’ আপনার একাউন্টেই জমা থাকবে। সুদেও বাড়বে। নিতে আপনাকে হবেই।


 আর একটা দিক আছে এই ‘আমি’ র। সেটা উপলব্ধি করা অতি কঠিন। এই ‘আমি’ র স্বরূপ সম্পর্কে কান্ট বলেছেন – Unknown and unknowable. বাবাজী লিখছেন, “এই ‘আমি’ হল সৎ । সৎ শব্দের অর্থ হল অস্তিত্ববান। এটা চৈতন্যময়। এই ‘আমি’ হল আনন্দস্বরূপ। এই আনন্দই কৃষ্ণ, এই আনন্দই আত্মা, এই আনন্দই দুর্গা। বিজ্ঞানের ভাষায় সবকিছুর মূল কারণ। 
যখন, এই আমি আনন্দ রূপে দেহে আবদ্ধ, তখন জীবাত্মা। আর যখন বিশ্বরূপে জগতে ব্যপ্ত, তখন পরমাত্মা। এই আমি নিজেই দ্রষ্টা, আবার নিজেই দ্রষ্টব্য।“ সোজা ভাষায় কর্তা ও কর্ম। খুবই জটিল বিষয়। যারা আমি তে বিশ্বাসী, তারা মনে করুন, আপনার ‘আমি’ আর আপনি এক নন। 
বাউল সাধকদের কাছে এই আমি হল মনের মানুষ। যিনি তার মনের মধ্যেই প্রতিবেশীর মতোই বাস করেন, কিন্তু তার কাছে যাওয়া খুব কঠিন। তাদের কাছে এই ‘মনের মানুষ’ হল ঈশ্বর। আমরা সবাই জানি, যারা সাধু মানুষ বা যারা সন্ন্যাস অবলম্বন করেছেন, তারা সবাই ত্যাগী পুরুষ। ঘর-সংসার, নিজের নাম, অভিমান, অর্থ – সবকিছু ত্যাগ করে আসে পরমার্থ পাওয়ার বাসনায়। কারণ, বাবাজী বলতেন সাধকের কাছে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সবচেয়ে বড় বাধা হল ‘টান’ – সেই টান, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া যেন, আর কিছুর প্রতি না থাকে। 


তিনি বলেছেন – “সাধু যদি জপ, ধ্যান না করে বা ঈশ্বরকে না ডাকে তবে কেবলমাত্র বৈরাগী, মহন্ত পদবী বা জটাদাড়ি, বেশভূষার দ্বারা সে যথার্থ সাধু হতে পারেন না।“ বাবাজী কেন বলতেন, ‘সাধু হওয়া খুব কঠিন কাজ, সাধুদের বড় কষ্ট।‘ বলতেন অনেক কষ্টে। যে কষ্ট শ্রীজানকীদাসজী মহারাজ পেয়েছিলেন, বাবাজীকেও সেই কষ্ট একসময় আঁকড়ে ধরেছিল। 
বাবা বুঝেছিলেন, কোথায় একটা ভুল হচ্ছে। শ্রীরামদাসজী মহারাজ চাইতেন না আশ্রমের বিস্তার হোক, দাদাজী মহারাজও বিলাস-ব্যসনহীন ভাবে সর্বত্যাগী রূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে গেছেন, সাধকের জীবনে যদি বিলাসিতা এসে যায়, সাধক তার পথ থেকে পতিত হয় বলে মনে করতেন বাবাজী মহারাজ। গুরুর ত্যাগব্রত শিষ্যকে চালিত করবে ধর্মপথে, কিন্তু গুরু যদি অর্থ ও নামের পথে ছুটে চলেন, আশ্রমে দান করা বে-আইনি অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করেন, তাহলে, তিনিও অজান্তে সেই পাপের পথে পা দেন। কারণ, সবার উপরে আছেন ভগবান, যার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় কারো নেই। 


সংসারের মঙ্গল কামনাই সাধকের ধর্ম। আর গুরুর ধর্ম হল শিষ্যকে পাপের হাত থেকে মুক্ত রাখা। খুব কঠিন এই আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সন্ন্যাসী বা গুরু হয়ে ওঠা। তাই বাবাজী বারবার সাবধান করতেন। 
তিনি আরেকটি কথা বলতেন- সেটি হল সংযম। তার কথায় সংযমই কামকে প্রেমে রূপন্তার করে। তার কথায় ভোগলালসা ত্যাগ না হলে প্রেম লাভ হয় না। বাবাজী বলতেন, ‘দেখিও সাধক ঠকে যেও না। প্রেমের সাধনা – কষ্ট সাধনা, ত্যাগের সাধনা। কিছুমাত্র ভোগ-আকাঙ্খা থাকতে, এটা হয় না।‘ 
বাবাজী গৃহস্থ-জীবনে ভগবদসাধনা প্রবন্ধে বলেছেন – সংসারে যারা কর্মযোগের সাধনা করার চেষ্টা করছেন, ভগবান তাদের সামনে অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্ট করে দেন। নির্জনবাসী কর্মত্যাগী সন্ন্যাসীর জীবনে এই সুযোগ কম আসে। 
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad