রজত রায়, সাগরদ্বীপ, ভয়েস ৯
“অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, ‘বাছা, কোথা যাবি ওরে!’
রাখাল কহিল হাসি,
‘চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি!।“
একদিকে পৌরাণিক উপাখ্যান, অন্যদিকে কিছু নির্মম ঘটনা আর রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’। সাগরসঙ্গমে দাঁড়িয়ে সবই মনে পড়ছে। একটা সময় গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দেওয়ার রীতি ছিল। এক চরম বিশ্বাসে ভর করে নারীরা তার প্রথম সন্তানকে বিসর্জন দিয়ে যেতেন। আর সেই করুণ কাহিনী থেকে একটু সরে কবিগুরু লিখলেন সেই সজল কবিতা ‘দেবতার গ্রাস।‘ সূর্য এখন অস্তাচলের পথে। এসেছি দিন দুয়েক আগে। একটু আগেই এসেছি।
ইচ্ছা আছে, মূল খবরের বাইরে অন্য কিছু লেখা। তাই ঘুরছি সাধু-সন্ন্যাসীদের আখড়ায় আখড়ায়। যদি নতুন কিছু মেলে। আমাদের সাংবাদিকদের কাজই তাই, নতুন কিছু খুজে বের করা। যা নতুন, তাই খবর। ইন্টারনেটের যুগে খবর বাসী হতে কয়েক মুহুর্ত লাগে।
কিন্তু, এমন কিছু খবর আছে, যা কয়েক শতাব্দীর পথ পেরিয়েও মলিন হয় না। যেমন, এই সাগরমেলা। এখানে এক অন্য জীবন। গোটা ভারত যেন এসে মিলিত হয়েছে এই সাগরসঙ্গমে। একটা সময় বড় দুর্গম ছিল এই সাগরদ্বীপ। এলে ফিরে যাওয়ার কোন নিশ্চয়তা ছিল না।
নদীপথে জলডাকাত, পথে ঠগি – প্রাণ নিয়ে মেলায় আসা, ফিরে যাওয়ার নিয়ন্তা ছিলেন একমাত্র ঈশ্বর। আজও নিয়ন্তা সেই ঈশ্বরই, কিন্তু শতাব্দী পেরিয়ে বামফ্রন্টের রাজত্ব পার হয়ে এখন আর সাগরদ্বীপে এসে বলতে হয় না – “সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার।“
গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে। উনবিংশ শতাব্দীর ‘হরকরা’ কাগজ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। বেশ কিছু প্রাকৃতিক কারণে কয়েকবার কপিল মুনির মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। শোনা যায়, বর্তমান মন্দিরের আগে আরও ৬টি মন্দির এই সাগরদ্বীপে। কিন্তু সমুদ্রের গ্রাসে সেই সব মন্দির তলিয়ে গেছে। বর্তমান মন্দিরটি ১৯৭১, কিংবা ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়। অযোধ্যার হনুমানগড়ি আশ্রমের মোহান্ত শ্রী রামদাসজী মহারাজের তত্ত্বাবধানে এটি স্থাপিত হয়েছিল। রা
জ্য সরকারের উদ্যোগে, এখন এই প্রাচীন মেলা হয়ে উঠেছে আধুনিক। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি বিদেশের বা দেশের পূণ্যকামী মানুষজনের জন্য চালু হয়েছে ই - স্নান ও ই – পূজা। ২০২১-২২ সাল নাগাদ এগুলি চালু হয়।
নিরাপত্তা। একদিকে কোভিডের হাত থেকে আত্মরক্ষা, অন্যদিকে যাতে কোনরকম দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য নিরাপত্তা। এবারে, সেই নিরাপত্তার চাদর বেশ মজবুত। প্রশাসনের ধারণা, কমপক্ষে ২৪ লক্ষ পার হতে পারে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা। স্বভাবতইঃ বেশ বড় চাপ প্রশাসনের।
আর এর জন্যই আকাশে ড্রোন, কচুবেড়িয়া থেকে সাগর পর্যন্ত ৬০০০ সিসিটিভি , আর সাগর মেলা এলাকায় বসানো হয়েছে ১২ টি ওয়াচ টাওয়ার। রাত ১০ টার পর ফেরি চলাচলে নিষধাজ্ঞা থাকা সত্বেও ৬ টি লঞ্চ গতকাল যাত্রী নিয়ে এখানে আসে। এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে জেলা প্রশাসন।
শুধু সাধু-সন্ন্যাসী নয়, পেটের টানে সাগরে হাজির নানা পেশার মানুষ। আছেন দোকানদার থেকে চুরি-বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিরাও। ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে নানা ধরণের ঠগরাও। সাধুর বেশ ধারণ করে মহিলাদের ঠকানোর জন্যও হাজির বেশ কিছু মানুষ। এদের জীবনে আছে নানা গল্প, কিছু চেনা, কিছু অচেনা। আজও সাগরমেলায় আসেন সন্তানকামী কিছু মহিলা, সেই অরম বিশ্বাসে ভর করে। প্রবল শীত উপেক্ষা করে উষ্ণ হয়ে উঠছে সাগরদ্বীপ।
চলবে