মহাকাশ আবহাওয়ার বিরুদ্ধে জ্যোতির্বিজ্ঞান মানবজাতির প্রধান প্রতিরক্ষা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বছর সৌর ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং প্রভাব হ্রাস করার জন্য একটি আন্তঃ-সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আইন পাস করেছে।
নাসা বলছে, সোলার সাইকেল ২৫ এর মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী অতিক্রম করছে। ফলে আগামী কয়েক বছরে সোলার ফ্লেয়ার বাড়বে বলে জানিয়েছে মহাকাশ সংস্থাটি। এবং এটি ২০২৫ সাল জুড়ে পৃথিবীর কাছে বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তারক ঘোষ
২০২৫ সালে আমরা হয়ত দেখতে চলেছি শতাব্দীর এক ভয়ঙ্কর সৌরঝড়। আর এমন কিছু দেখতে চলেছি, যা দেখা যায় একমাত্র হলিউডের সায়েন্স ফিকশন ছবিতে।
২০১৯ সাল থেকে আমরা প্রবেশ করেছি সৌরচক্র ২৫ এ। সৌর চক্র ২৫ এর মাঝামাঝি সময়ে সৌরঝড় সর্বাধিক ঘটবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তাই নভেম্বর ২০২৪ এবং মার্চ ২০২৬ এর মাঝমাঝি সময় অর্থাৎ জুলাই ২০২৫ এর মধ্যেই ঘটতে চলেছে সেই ভয়ঙ্কর সৌরঝড়, যা বদলে দিতে পারে পৃথিবীর অনেক কিছু, এমনকি এই মানব-সভ্যতাও পড়তে পারে স্থায়ীত্বের এক বড় প্রশ্নের মুখে। ই
তিমধ্যেই, এই পৃথিবীর বুকে এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, যা বিজ্ঞানীদের ভাবাতে শুরু করেছে। যদিও গড় মানুষের বিশ্বাস কিছু হবে না, কিন্তু ‘কিছু’ হওয়া শুরু হয়ে গেছে অনেকদিন আগে থেকেই।
দেশ ও বিদেশের নানা স্থানে ঘন ঘন ভূমিকম্প। মহাকাশে ভাসমান উপগ্রহের বা রকেটের ভূপৃষ্ঠে পতন, কোন কারণ ছাড়াই। আবহাওয়ার খামখেয়ালীপনা, পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ বেড়ে যাওয়া।
নানা ধরণের ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকা। সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রার ব্যপক পরিবর্তন এক সুগভীর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর এই সতর্কতা মানবজাতি যদি হালকাভাবে নেয়, তাহলে কী হতে পারে, সেটা অদূর ভবিষ্যতই বলে দেবে।
আমাদের ইন্টারনেট, ব্যাঙ্ক, বিমান, রেল, বিদ্যুত-বন্টন, যোগাযোগ সবকিছুই মহাকাশে ভাসমান উপগ্রহ নির্ভর। সূর্য থেকে নির্গত শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ওয়েভ তীব্রবেগে সেগুলির উপর প্রথমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। এরপর সেগুলি ঝাঁপিয়ে পড়বে এই পৃথিবীর বুকে।
পৃথিবীর একটি নামী পত্রিকা ‘ফোর্বস’ লিখছে – “সূর্য নাসার পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে।“ এর অর্থ হল, নাসা আগেই যে ইঙ্গিত দিয়েছিল সূর্যের বুকে যে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে। সেটা কিন্তু অতি দ্রুতগতিতে ঘটছে।
সূর্যের প্রায় ১১ বছরের একটি চক্র রয়েছে। এই ১১ বছরের মধ্যে সূর্য পৃষ্ঠে ‘সান স্পট’ এর সংখ্যা বাড়তে বা কমতে থাকে। ১৭৫৫ সাল থেকে প্রতিদিন এটি গণনা করা হয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলছেন- এই ১১ বছর বা তার বেশি বছর ধরে "সৌর ন্যূনতম" (যখন সবচেয়ে কম সানস্পট থাকে) এবং "সৌর সর্বাধিক" (যখন সর্বাধিক সানস্পট থাকে) রূপে থাকে।
নাসার হেলিওফিজিক্স বিভাগের পরিচালক নিকোলা ফক্স বলেছেন, "সূর্যের কার্যকলাপ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যদিও আমরা এই চক্রে শীর্ষ স্তরে পৌঁছাতে পারিনি, তবু, সূর্যের ক্রিয়াকলাপ ইতিমধ্যে পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৫ সালে আমরা সৌর শক্তির সর্বোচ্চের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সৌর কলঙ্কগুলি বাড়তে থাকবে এবং পৃথিবীতে আমাদের জীবন ও প্রযুক্তি, পাশাপাশি মহাকাশে উপগ্রহ এবং নভোচারীরা প্রভাবিত হবে।“
স্বভাবতইঃ ইঙ্গিতটা হাল্কাভাবে নেওয়ার নয়। যাইহোক, সৌর চক্র ২৪ এর প্রভাব খুব একটা ছিল না। ২০১৪ সালের এপ্রিলে এর সৌর সর্বাধিক ঘটেছিল যখন সানস্পটগুলি ১১৪-এ পৌঁছেছিল। গড় ১৭৯। নাসা এবং ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) যৌথভাবে স্পন্সর করা বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক দল সৌর চক্র ২৫ ভবিষ্যদ্বাণী প্যানেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে সৌর চক্র ২৫ সৌর ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেও গড়ের চেয়ে কম হবে।
কিন্তু, নাসা কতটা স্বচ্ছভাবে সবকিছু জানাচ্ছেন, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে।
দেখা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পূর্বাভাসের দ্বিগুণেরও বেশি সানস্পট - প্রত্যাশিত ২৬ টির তুলনায় ৬৭ টি। বেশ অনেকটাই। ১৯৮৯ সালে একটি সৌর ঝড় কানাডার কিছু অংশে ব্ল্যাকআউট সৃষ্টি করেছিল।
২০০৩ সালের অক্টোবরে সূর্যে অগ্ন্যুৎপাতের পর সৌর পদার্থের বিশাল মেঘ সৃষ্টি করেছিল। এর বেশিরভাগই পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আঘাত হানে, যার ফলে একটি ভূচৌম্বকীয় ঝড় তৈরি হয় যা জিপিএস সংকেত এবং রেডিও ট্রান্সমিশনকে বিঘ্নিত করে এবং উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে দৃশ্যমান একটি অরোরা তৈরি করে। তখন, বিকিরণের সংস্পর্শ কমাতে বিমানগুলোকে কম উচ্চতায় উড়তে নির্দেশ দিয়েছিল মার্কিন বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শ্রীনিবাসন বলেছেন –“সৌভাগ্যবশত, ১৮৫৯ সালের ক্যারিংটন ইভেন্ট ভূ-চৌম্বকীয় ঝড়ের সময় কোনও মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি, তবে এটা বেশ স্পষ্ট যে উল্লেখযোগ্য বিকিরণ হবে।" এর ফলে, কিছু দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে এটা আমাদের ডিএনএ, বা আমাদের দেহস্থ কোষগুলির কী করবে তা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা সুরক্ষিত নয় এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষত সত্য হবে- যেমন মহাকাশচারীরা।“
শ্রীনিবাসন সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "সূর্যের পৃষ্ঠে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বোঝা, ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং সূর্যের অভ্যন্তরে কী ঘটবে তা আমাদের পথে আসা বিপর্যয়কর প্রযুক্তিগত ব্যর্থতাগুলি এড়ানোর জন্য অপরিহার্য - আমার কোনও সন্দেহ নেই যে এটি কোনও সময় ঘটবে।
নাসা বলছে - ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইডিটি সকাল ১০টা ৪৮ মিনিটে সূর্য একটি শক্তিশালী সৌর শিখা নির্গত করে। সূর্যকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা নাসার সোলার ডায়নামিক্স অবজারভেটরি, এই ঘটনার একটি ছবি তুলেছে।
এছাড়া, ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা ১৬ মিনিটে সূর্য আর একটি শক্তিশালী সৌর শিখা নির্গত করে। নাসার সোলার ডায়নামিক্স অবজারভেটরি, এর ছবিও তুলেছে।
আগামী বছরগুলিতে সৌর ফ্লেয়ারগুলি বৃদ্ধি পাবে তা জেনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে, সূর্য গত কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে শক্তি এবং সৌর পদার্থ নির্গত করার হার বাড়িয়ে চলেছে।
আর এটা সৌর ফ্লেয়ারকে তার ১১ বছরের চক্রের শীর্ষে পৌঁছানো ছাড়াই। এটাই অদ্ভুত এবং আশঙ্কার।
সূর্য যখন সৌর সর্বোচ্চের দিকে অগ্রসর হয়, তখন সেই সৌর শিখাগুলি বৃদ্ধি পায়, যেমন ভূচৌম্বকীয় ঝড়ের পরিবর্তন। এই ঝড়গুলি জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেম, স্যাটেলাইট এবং এমনকি মহাকাশযানের পক্ষে বেশ কয়েকটি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
আমরা সম্প্রতি দেখেছি যে পুরানো মহাকাশ রকেটের ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে কারণ সৌর ক্রিয়াকলাপের কারণে এর কক্ষপথটি দ্রুত স্থানান্তরিত হয় এবং এর পতন ঘটে।
এর ফলে, ঘটনা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, কারণ অনিয়ন্ত্রিত মহাকাশ ধ্বংসাবশেষ এই গ্রহের উপর আছড়ে পড়তে পারে। ফলে, এই গ্রহে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী জীবনের পক্ষে বিপদ সৃষ্টি করবে।
অবশ্যই, নাসা এবং অন্যান্য সংস্থাগুলি ক্রমাগত সৌর ফ্লেয়ার ক্রিয়াকলাপ দেখার জন্য সূর্যের উপর নজর রাখছে।