তারক ঘোষ
বাবাজী মহারাজ এমন একজন সাধক ছিলেন যার মধ্যে ছিল শিক্ষার ৫টি দিক। একদিকে সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ব, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে কখনো ঠোকাঠুকি হয়না। একটি কথা প্রচলিত আছে – “বিজ্ঞান যেথা পথ হারায়, দর্শন বিনা গতি নাই।“
আমরা যদি পৃথিবীর অন্য দেশের দিকে দেখি, তাহলে দেখতে পাব, বহু বিরাট মাপের দার্শনিকরাই বিজ্ঞানের নতুন পথ দেখিয়েছেন। কাজেই দর্শন ও বিজ্ঞানে লড়াই নেই, লড়াই আছে মানুষের অজ্ঞানতা ও জানার ইচ্ছার মধ্যে। অনেক কিছু না জেনে অনেকেই তর্কে নেমে পড়েন। আর সেই তর্ক অনেক সময় যুক্তির ধার ধারে না। আমরা যদি, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার কথা জানতে চাই, বিজ্ঞান তার উত্তর দিতে পারবে না। ‘আমি’ ঠিক কে, এর উত্তরও বিজ্ঞান দিতে পারবে না। ‘মন’ কি? এর ভাসাভাসা উত্তর দেওয়া ছাড়া বিজ্ঞানের সেরকম করণীয় কিছু নেই। একটা জায়গায় গিয়ে বিজ্ঞানকে তাকিয়ে থাকতে হয় দর্শনের দিকে।
আবারও বলি, বাবাজী এই জগতকেও অস্বীকার করেন নি, আবার ঈশ্বরকেও অস্বীকার করেন নি। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক এমন এক দার্শনিক, যার তুলনা খুব কমই আছে।
সেবার বাবাজী আশ্রমে বসে আছেন। জন্মাষ্টমীর পরের ঘটনা। বেলা ১১ টা হবে। বেশ গরম। সাইকেল চড়ে কয়েকজন ছেলে এল আশ্রমে। বাবাজী মহারাজ তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, “আপনারা কোথা থেকে আসছেন? বেশ গরম আজকে।“
বাবাজী উঠে ফ্যানের স্যুইচ অন করে তাদের দাওয়ায় বসতে বললেন। তারা সবাই দাওয়ায় উঠে এসে বসলেন। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আচমকাই বাবাজীর দিকে তাকিয়ে একটি ছেলে বলে উঠল –“ আচ্ছা, আপনি এর আগে কোথায় ছিলেন? এই বন-বাদাড়ের জায়গায় এলেন কেন?” তার গলায় তাচ্ছ্যিলের সুর।
বাবাজী মহারাজ একটুও না রেগে হাসিমুখে বললেন –আমি বৃন্দাবন থেকে এসেছি।
অন্য একটা ছেলে বলে উঠল – বিজ্ঞান তো ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। রবীন্দ্রনাথও ভগবানে বিশ্বাস করতেন না।
বাবাজী সে সব প্রশ্ন এড়িয়ে জানতে চাইলেন, তারা কে কী বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে। উত্তরে জানা গেল, একজন কলা বিভাগের ছাত্র, বাকীরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে।
বাবাজী সেসব কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কবিতা থেকে ঈশ্বর সম্পর্কিত উদ্ধৃতি দিতে লাগলেন।
কিন্তু, কে শোনে!
তারা একের পর এক প্রশ্ন করে, বাবাজীর কথা বন্ধ করে দিতে চাইছিল।
বাবাজী কথা থামিয়ে বললেন, “দেখুন আপনারা তো আমাকে বলতেই দিচ্ছেন না। তাছাড়া আপনাদের শোনার আগ্রহও নেই। শাস্ত্র বলছে, সত্যকার জানা, সত্যকার শ্রোতার ভাগ্যেই ঘটে থাকে।“ সকলে তখন চুপ।
বাবাজী অনুমতি দিলে শিশিরবাবু বলতে শুরু করলেন রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সভাপতি স্বামী গম্ভীরানন্দজী ও বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথোপকথনের একটি ঘটনা।
মেঘনাদ সাহা গম্ভীরানন্দজীকে বলেন, “তুমি লিখেছ বিজ্ঞানের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের কোন বিবাদ নেই। কিন্তু, এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।“
গম্ভীরানন্দজী বললেন, “কেন? বাধা কোথায়?”
মেঘনাদ সাহা বললেন, “পদে পদে বাধা। বিজ্ঞান প্রমান ছাড়া কিছু গ্রহণ করে না। কিন্তু, তোমরা যে ভগবানের কথা বলো, তা তোমরা বাস্তবে দেখাতে পারবে না। কাজেই অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিবাদের কোন মীমাংসা আজও হয়নি।“
বাবাজী মহারাজের নির্মিয়মান ওয়েবসাইট সম্পর্কে কিছু কথা। অনুগ্রহ করে ভিডিওটি দেখুন ও শেয়ার করুন।
এরপর, গম্ভীরানন্দজী তার এক পরিচারক ঝাড়ুদারকে বললেন, ওদের কাছ থেকে বিজ্ঞানের জটিল একটা বিষয় বুঝে নিতে।
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ সাহা তখন নিশ্চুপ। তারা কী করে একজন অশিক্ষিত ঝাড়ুদারকে বিজ্ঞানের জটিল তত্ব বোঝাবেন।
গম্ভীরানন্দজী তখন মৃদু হেসে বললেন, “বুঝতে পারছ, ওকে যেমন তোমরা বিজ্ঞানের জটিল বিষয় বোঝাতে পারছ না, তেমনি ভগবানকেও ঈশ্বরভক্ত ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। সমস্ত বিষয়টাই সাধনার। আর এই সাধনার জন্যই, কেউ কবি হয়, কেউ বিজ্ঞানী, কেউ সন্ন্যাসী, কেউ বা দার্শনিক।“
শিশিরবাবুর কথা শেষ। সেই কলেজ পড়ুয়ারা তখন নিশ্চুপ। তারা আর একটি কথা না বলে চলে গেল।
এর মাঝে একসময় বাবাজী মহারাজ ঠাকুরজীকে ভোগ নিবেদন করে এসেছেন।
একটু পরে বিষ্ণুদাসজী বাবাজীর সামনে ভোগের থালা সাজিয়ে দিলেন। সবাই প্রসাদ পাচ্ছেন। বাবাজী চুপ করে বসে আছেন। তার মনে তখন একটাই চিন্তা। ছেলেগুলো সাইকেলে করে এত রোদে বাড়ি ফিরবে, প্রসাদ পেয়ে গেল না। কত কষ্ট হবে ওদের। তিনি প্রসাদ গ্রহণ করতে পারছেন না। তার মনের আয়নায় তখন ওই অভূক্ত ছেলেগুলোর মলিন মুখের ছবি।
শিশিরবাবু, প্রসাদ পাওয়া থামিয়ে বলে উঠলেন, “ওরা তো প্রসাদ পেতে আসেনি। এসেছিল সাধু ঠকাতে। ঠাকুরজীর ইচ্ছাতেই ওরা প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আপনি বৃথাই কষ্ট পাচ্ছেন। সবই ঠাকুরের ইচ্ছা।“
সেদিন বাবাজী কিন্তু কষ্ট পেয়েছিলেন। কেননা, সবাই তো জানতেই চাইবে। ওদের অপরাধ নেই, না জানাতে পারাটাই অপরাধ।