শ্রীদাদাজী মহারাজের মতো বাবাজী মহারাজও বলতেন – সাধু হওয়া সহজ নয়। সাধু সাজা সহজ। একজন ভাল অভিনেতা বা বহুরূপী সেটা অনায়াসেই করে দিতে পারেন, কিন্তু সাধুর অন্তর? সেটা পাওয়া কি সহজ? তাই যিনি অন্তরে সাধু, তিনিই প্রকৃত সাধু।”
শ্রীশ্রী জানকীদাসজী বাবাজীকে বলেছিলেন – ‘মনে রেখ কর্তব্য সর্বদা নীরস হয়।‘ আর বাবাজী মহারাজ সারা জীবন শ্রীদাদাজী মহারাজের আদেশ শিরোধার্য্য করে এগিয়ে গেছেন। এমনকি নিন্দা-অপমান সহ্য করেও গুরু-কর্তব্য পালন করে গেছেন। শ্রীদাদাজী মহারাজ আমাদের বাবাজীকে বলেছিলেন –‘বিরাট শিক্ষিত হতে হবে, নইলে মানুষ সম্মান দেবে না। শিক্ষিত না হলে সাধুকে দেখে লোকে বলবে, চাকরি পায় নি, পেটের জ্বালায় সাধু হয়েছে।‘
শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলে, ভারতীয় সংষ্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে সুগভীর পড়াশোনা না থাকলে, তিনি সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারবেন না। আধ্যাত্মিকতা, বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ সহ আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি, সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কেও ধ্যান-ধারণা থাকা প্রয়োজন।
আমি এখানে সেই সমস্ত সাধুদের কথা বলছি, যারা সমাজ ও ধর্ম সংষ্কারের জন্য এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। মনে রাখতে হবে, সবাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হতে পারেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ হাজার শতাব্দীতে একজন করে জন্মান।
দাদাজী মহারাজ বাবাজী মহারাজকে তাই বলেছিলেন – ‘একজন এম এ পাশ, আর একজন এম এ পাশকেই বুঝতে পারবে।
এখানেও আমি সত্যিকারের সুশিক্ষিত এম এ পাশ করা ব্যক্তির কথা বলছি, যার মধ্যে জ্ঞান আছে, যিনি সার্টিফিকেট সর্বস্ব নন। আমি স্মরণ করি নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের সেই মহামানবদের, যাদের জীবন-বাণী যুগ যুগ ধরে মানব-সমাজ ও মানবিকতাকে অক্সিজেন যুগিয়ে চলেছে।
আমরা দেখেছি, এই নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু ডক্টরেট আছেন, বহু জ্ঞানী পুরুষ আছেন, যারা তাদের জ্ঞান ও নতুন নতুন আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন ও মনকে আলোকিত করেছেন।
জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের নির্লোভ চরিত্র, কুসংষ্কার বিহীন মন, গুরুভক্তি, সাধন-ভজন, তাদের সরল জীবন-যাপন মানুষকে মুগ্ধ করেছে, না চাইলেও তাদের দেখে মস্তক অবনত হয়েছে। আর একটি বিষয় তাদের মধ্যে ছিল, সেটা হল অনমনীয় মেরুদন্ড।
অন্যায়কারীকে তার অন্যায় এর জন্য শাস্তি দিয়েছেন, আবার সেই শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটার জন্য নীরবে চোখের জলও ফেলেছেন।
সেই প্রসঙ্গেই আজকের এই ঘটনার কথা, যা শ্রীবাবাজী মহারাজের কলমে উঠে এসেছিল। সেই তথ্যই আজ আপনাদের জানাচ্ছি।
শ্রীদাদাজী মহারাজ সাধু হয়েই জন্মেছিলেন, তাকে সাধু বনতে হয়নি। তিনি ছিলেন ত্যাগের প্রতিমূর্তি। একবার দাদাজী মহারাজের ব্রজ পরিক্রমাকালে এক ‘অসাধু সাধু’ সাধুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে চুরি-চামারী শুরু করে। যথারীতি, অন্য সাধুরা সব জানতে পেরে দাদাজী মহারাজকে সব নিবেদন করেন।
দাদাজী মহারাজ তখন মহন্ত। তিনি তাই কয়েকজন সাধুকে দায়িত্ব দিলেন, কে এই অকাজ করছে, তা খুঁজে বের করার জন্য। শেষপর্যন্ত ধরা পড়ল চোর।
দেখা গেল, সেও এক 'সাধু'। অন্ততঃ তার বাইরের ভেক সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
চোর ‘সাধু’কে দেখে আশ্রমের অন্যান্য সাধুরা তো রেগে আগুন। তারা তাকে শাস্তি দিতে চায় নিজেদের হাতে। কেউ বলেন, পুলিশ ডেকে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে।
দাদাজী মহারাজ পড়লেন মহা সমস্যায়। তিনি একদিকে ছিলেন কোমল স্বভাবের, আবার অন্যদিকে ছিলেন অন্যায় এর প্রশ্নে অত্যন্ত কঠোর।
সবাই তাকিয়ে আছেন মহন্তজীর দিকে। দাদাজী পড়লেন দোটানায়। ওই ‘সাধু’কে ছেড়ে দিলে, সবাই অন্য কিছু ভাবতে পারেন। কারণ, ওই ‘সাধু’ শুধু মানুষকেই ঠকান নি ভেক ধারণ করে ঈশ্বরকেও ঠকানোর চেষ্টা করেছেন।
আবার পুলিশের হাতে তুলে দিলে, পুলিশ মেরে হাড়-গোড় ভেঙ্গে দেবে।
ভেকধারী সাধু তখন কান্নাকাটি শুরু করেছেন তাকে পুলিশে না দেওয়ার জন্য।
শেষে বাবাজী এক নাপিতকে ডেকে আনতে বললেন। সবাই অবাক। নাপিত হাজির হলে দাদাজী মহারাজ আদেশ দিলেন, ওই ‘সাধু’র মাথার অর্ধেক কামিয়ে দিতে। তারপর গোঁফ ও দাড়ির অর্ধেক।
সেই আদেশ পালিত হলো। এরপর তার এক গালে চুন আর অন্য গালে কালি লাগিয়ে দেওয়া হল। এরপর দাদাজী ওই চোরকে আদেশ দিলেন সকল সাধুদের দন্ডবত প্রণাম করে প্রতিজ্ঞা করতে যে সে আর জীবনে এই ধরণের অপরাধ করবে না।
ওই সাধু বেশী চোর তাই করল।
দাদাজী মহারাজ সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবার তোমরা খুশি হয়েছ?’
সবাই বললেন, তারা খুশি।
শ্রীদাদাজী মহারাজ এরপর একটি কথাও না বলে চলে গেলেন তাবুর ভিতরে, সেখানে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। একজন সাধুবেশীকে এই ধরণের দন্ড দিতে হল বলে।
দাদাজী মহারাজের সেদিনের এই রূপ মনে করিয়ে দেয় কবিগুরুর সেই কবিতা-
“দন্ডিতের সাথে দন্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।“
শ্রীদাদাজী মহারাজের মতো বাবাজী মহারাজও বলতেন – সাধু হওয়া সহজ নয়। সাধু সাজা সহজ। একজন ভাল অভিনেতা বা বহুরূপী সেটা অনায়াসেই করে দিতে পারেন, কিন্তু সাধুর অন্তর? সেটা পাওয়া কি সহজ?”
সাধনা দরকার, গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি দরকার। আর দরকার কর্মযোগ। শ্রীদাদাজী মহারাজ তাই বলতেন – কর্মযোগে অভ্যস্ত না হয়ে সন্ন্যাস নিতে গেলে, তা দুঃখের কারণ হয়।
“সন্ন্যাসন্তু দুঃখমাপ্তুম অযোগতঃ”