দুর্ভাগ্য আমাদের, এইরকম একজন সাধককে পেয়েও, আমরা তার কাছে পারমার্থিক বিষয় না চেয়ে, পার্থিব বিষয় চেয়েছি। আজ তাই লজ্জা লাগে। কী হারালাম, সেটাও বুঝতে পারলাম না।
বাবাজী মহারাজকে চেনা খুব কঠিন ব্যাপার, কারণ তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকতেন। শ্রীগীতার টিকা অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু, শ্রীবাবাজীর গীতার টীকা পড়লেই বোঝা যায়, তিনি কোন শ্রেণির টিকাকার ছিলেন। তার কাছে প্রশ্ন নিয়ে হাজির হওয়া অনেক ভক্তই বলেছেন – ‘বাবার কাছে অনেক প্রশ্ন নিয়ে গেছি, তখনো নিবেদন করা হয়নি। অথচ, আশ্চর্য্য হয়ে দেখেছি, সেইদিন বাবা যা আলোচনা করলেন, সেখান থেকেই আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।‘ শুধু, এটাই নয়।
দেখা গেছে, বাবাজী মহারাজের তিরোধানের পর, বাবাজীর ভিডিও চালিয়ে বহু মানুষ সেখান থেকেই তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।
বাবাজী মহারাজ বুঝতে পারতেন তার চারপাশের মানুষজনদের, ভক্তদের। কে কীজন্য এসেছেন, তা আগাম বুঝেই, সেইমতো উত্তর দিয়ে দিতেন। বাবাজী মহারাজের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা কারো ছিল না, আর আজও নেই। তিনি আজও আমাদের উপর তার লক্ষ্য রেখে চলেছেন।
বাবাজী মহারাজ বলতেন – গুরুমন্ত্র জপ করে যা, সব উত্তর পেয়ে যাবি। বাবাজী বলতেন, একমাত্র গুরুমন্ত্র জপের মধ্য দিয়েই গুরু-শিষ্যের যোগাযোগ থাকে। আর গুরুর দেহান্তে পর, এই বীজমন্ত্র জপই, তার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কেউ বিশ্বাস করুন, বা না করুন, আমি এর অনেক উদাহরণ নিজের জীবনে পেয়েছি। তাই বলতে চাই, যারা নিয়মত অন্ততঃ একবারও দিনে জপ করেন, তাদের জীবনে সমস্যা এলেও, থাকবে না।
বাবা তাদের জীবনের সব সমস্যা দূর করে দেবেনই দেবেন। আমি আমার বিশ্বাস থেকেই এ কথা বলছি। নিয়মিত জপ করুন, বুঝে যাবেন, মানসিক শান্তি কাকে বলে।
আমি একসময় জপ ছেড়ে দিয়েছিলাম। সময় নেই, এই অজুহাতে। তারপর আমার জীবনে ঘটে একের পর এক বিপত্তি। একসময়, আবার ফিরে আসি জপে। বাবাই আমার ঘাড় ধরে জপের আসনে বসিয়ে দেন।
বাবাজীর মধ্যে দুটো রূপ দেখেছিলাম – একটা কঠোর, অন্যটা কোমল। আর এই কঠিন-কোমলে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন, এক সত্যিকারের শিক্ষক, যিনি আমাদের জীবন পথের সঠিক ঠিকানা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কেউ নিতে পেরেছি, কেউ পারিনি।
বাবাজী মহারাজ গীতার একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন – গৃহের মালিক যদি ভাল হন, শক্ত হন, তবে গৃহবাসীরা আনন্দে থাকেন। এই জগতের যিনি মালিক, সেই ভগবান প্রেমিকও, আবার কঠোরও। তাই আমাদের কোন ভয় নাই।
‘গীতা চিরন্তনে’ তিনি বলছেন – অনেক সময় ধর্মে বিকার আসে, আর সেই বিকৃত ধর্মকেই মানুষ আসল ধর্ম বলে মনে করেন।
আশ্রমে যদি তপস্যার বদলে ইন্দ্রিয়ভোগ চলে, ত্যাগী সন্ন্যাসীর বেশ ধরে, কেউ যদি অধর্ম করে, ধর্মের স্থানে যদি অধর্ম হয়, তবে একসময় ভগবানকে নেমে আসতেই হয়। ধর্ম স্থাপনার জন্য তাকে আসতেই হয়, আসতেই হবে।
আমি এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী। যেখানে এই ধরণের পাপের পরিণতি দেখেছি কতটা নির্মম হয়। মনে রাখতে হয়, ভক্তরাই সব। আজ তারা একজনকে মাথায় নিয়ে নাচতে যেমন পারেন, অন্যায় দেখলে, তাকে মাথা থেকে মাটিতে নামাতে তাদের বেশি বেগ পেতে হয়না।
পাপ ক্রমশঃ জড়িয়ে ধরছে, সমগ্র সমাজটাকে। বাবাজী এই ভয়টাই পেতেন। তাই সাবধান করতেন।
কিন্তু, কে শোনে কার কথা! ব্যাভিচার এখন আর ব্যাভিচার নয়, নিজের ক্ষমতা দেখানো। দেখো, আমি কতজনকে নিয়ে থাকতে পারি! বেআইনিভাবে অর্থ লুঠ এখন মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে। পরের সম্পদে পোদ্দারী, এখন নিত্যদিনের অতি সাধারণ ঘটনা।
আর এসবই একসময় ডেকে আনবে চরম পরিণতি। আর এই সবকিছুর পিছনে আছে লোভ। যারা বর্তমান বিষয়ে খোঁজ রাখেন, তারা দেখতে পাচ্ছেন, লোভের পরিণতি কী হয়। টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই বুঝে যাবেন।
বাবাজী গীতার আর একটি শ্লোকের টীকায় বলছেন – যে জিনিষ তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, তা তাড়াতাড়ি চলেও যায়।
চারিধারে, এমনকি নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, মিলে যাবে বাবাজীর কথা।
আর একটি শ্লোকের ব্যাখ্যায় বাবাজী মহারাজ বলছেন – আমরা যদি সর্বপ্রকার আশা ত্যাগ করতে পারি, তাহলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারি। ‘নৈরাশ্যং হি পরমং সুখম’ – এখানে নৈরাশ্য বলতে হতাশাকে বলা হয়নি, কামনা ত্যাগকে বলা হয়েছে।
কর্মের ফল কামনা ত্যাগ করতে পারলেই যথার্থ কর্মজীবনের শুরু হয়। তবে, সংকীর্ণ, স্বার্থমগ্ন, সুখী গৃহকোণ লোভী ব্যক্তিরা এটা করতে পারেন না। তাদের অনেক পিছুটান থাকে।
আগেই বলেছি, বাবাজী মহারাজ সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন, তাই এই সমাজে কী কী ভয়ঙ্কর ব্যাধি আসতে পারে, তা তিনি আগাম বলে গিয়েছিলেন। মানুষ কীভাবে, নিজেরই পাতা ফাঁদে আটকে পড়বে, তাও তিনি বলে গেছেন।
দুর্ভাগ্য আমাদের, এইরকম একজন সাধককে পেয়েও, আমরা তার কাছে সংসারের ভালোমন্দের কথা জানতে গেছি, ছেলে-মেয়েদের নামকরণ, অন্নপ্রাশন, মেয়ের বিয়ে, রোগভোগ নিয়ে ছুটে গেছি আশ্রমে। আশ্রমটা গৃহ বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছি, কিন্তু গৃহটাকে আশ্রম বানানোর কথা ভাবিনি।
গুরুদেবের কাছে পারমার্থিক বিষয় না চেয়ে, পার্থিব বিষয় চেয়েছি। আজ তাই লজ্জা লাগে। কী হারালাম, সেটাও বুঝতে পারলাম না। এমনকি বাবার দেওয়া মন্ত্রও জপ ভুলতে বসেছি। এটাই কি তাহলে শেষের শুরু?