‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণ জোর-পূর্বক শ্রীরাধার সঙ্গে বেশ কয়েকবার মিলন করেন, কিন্তু এর পিছনে আসল সত্য কি? ২

গোপন কামজ্বরে পীড়িত হয়ে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমে পড়া নারী-পুরুষ রাধা-কৃষ্ণের এই ‘লীলা’কেই আশ্রয় করে ‘সাধু’ সাজতে চান।
নেকেই জানতে চান, শ্রীরাধা কি সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের মামী ছিলেন? আর সেই মামীর সঙ্গেই শ্রীকৃষ্ণ প্রেম ও সহবাস করেন? সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা, আমাদের বাঙ্গালী সমাজের একটা বিরাট অংশ, রাধা-কৃষ্ণকে যেভাবে অবৈধ প্রেমের প্রতীক হিসাবে দেখে, তাদের মিলন দৃশ্য নিয়ে আদিরসাত্মক উল্লাসে পুলকিত হয়, তার পিছনে অনায়াসেই বড়ু চণ্ডীদাসের এই কাব্যের একটা প্রভাব সেই মধ্যযুগ থেকেই ছিল। 
বাঙ্গালী সমাজের একটা অংশ সেই প্রভাব আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই কোথাও পরনারীর সঙ্গে বা পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম বা দেহমিলনের ঘটনা ঘটলেই বাঁকা চোখে অনেকে বলে ওঠেন,’রাধা-কেষ্টর লীলা হচ্ছে গো।‘ অনেকে বলেন, ‘ঠাকুর করলে দোষ নেই, মানুষে করলেই দোষ।‘
অদ্ভুত এই ভাবনা। এর পিছনে আসল সত্য না খুঁজে যুগে যুগে এই ভাবনাতেই চালিত হয়েছে মানুষ। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধাকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানা আদিরসাত্মক গান, আঁকা হয়েছে আপাত-অশালীন ছবিও। আর গোপন কামজ্বরে পীড়িত হয়ে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমে পড়া নারী-পুরুষ রাধা-কৃষ্ণের এই ‘লীলা’কেই আশ্রয় করে ‘সাধু’ সাজতে চেয়েছেন।
 এখন দেখা যাক, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কী বলা হয়েছে। এই কাব্যের মূল বিষয় হলো বিষ্ণুর অবতাররূপে কৃষ্ণের জন্ম, বড়ায়ির সহযোগিতায় বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তার প্রেম ও মিলন এবং সবশেষে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় গমন। আর এই কাব্যে রয়েছে তিনটি প্রধান চরিত্র কাহ্নাঞি (কানাই বা কৃষ্ণ), রাধা, বড়াঞি। 
১৩ খণ্ডে বিভক্ত এই কাব্যের শেষ অংশটির নাম ‘রাধাবিরহ’। তবে, এই অংশটির শেষের পৃষ্ঠাগুলি পাওয়া যায়নি। এই কাব্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রয়েছে আদিরস। শ্রীরাধার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের মিলন-দৃশ্যের বর্ণনা পাঠককেও কামজ্বরে আক্রান্ত করেছে।
‘দান খণ্ডে’ দেখা যায় কৃষ্ণ দানী সেজে রাধাকে নৌকো করে অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার সঙ্গে থাকা নানা জিনিষ, এমনকি তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্যও দান অর্থাৎ পরোক্ষে আলিঙ্গন চান। কাব্য থেকে জানা যায় এই খন্ডেই প্রথম রাধার বয়স ১১ বছর বলা হয়েছে।
 এই খন্ডে কৃষ্ণ নিজেকে অসুরবিনাশী কালীয়দমনকারী শ্রীকৃষ্ণ রূপে নিজেকে পরিচিত করেছেন। এবার দেখা যাক, শ্রীকৃষ্ণ কী কী দান চেয়েছিলেন – কৃষ্ণ বলেন, রাধার কাছে তার নয় লক্ষ কড়ি এবং বারো বছরের মহাদান বাকী আছে। রাধা তখন কৃষ্ণের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। কিন্তু, কৃষ্ণ সে কথায় কান দেন না।
 এরপর রাধা বলেন, তিনি তার মামী, তার সঙ্গে এসব ঠিক নয়। কিন্তু, রাধা কৃষ্ণকে মামী-ভাগনার কথা বললেও কৃষ্ণ রাধার প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের জন্য দুই কোটি মুদ্রা দান চেয়ে বসেন। 
শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের কাছে নিরুপায় রাধা কৃষ্ণকে দেহদান করেন। 
এরপর থেকে রাধা কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। এরপর আসে 'নৌকাখণ্ড'।
 'নৌকাখণ্ডে' কী হয়েছে দেখে নেওয়া যাক। 
এই খন্ডে কৃষ্ণ নৌকার মাঝি সেজেছেন। এই খন্ডে রাধা শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে ষোলোশো গোপিনীর সঙ্গে মথুরার হাটে গেছেন। এই খণ্ডে দেখা যায়, কৃষ্ণ মাঝির ছদ্মবেশ ধারণ করে কেবলমাত্র একজন পার করা যায় এমন একটি নৌকাতে রাধাকে তুলে মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেন এবং রাধার সঙ্গ লাভ করেন।
 নদী তীরে উঠে লোকলজ্জার ভয়ে রাধা সখীদের বলেন যে, নৌকা ডুবে গিয়েছে, কৃষ্ণ না থাকলে সে নিজেও মরত, কৃষ্ণ তার জীবন বাঁচিয়েছে।
‘ভার-খণ্ড’ ও ‘ছত্র-খণ্ড’ এ দেখা যায় দুটি আলাদা আলাদা দৃশ্য। তখন হেঁটেই মথুরাতে গিয়ে দই-দুধ বিক্রি করতে যেতেন রাধা। কিন্তু, আগের ঘটনার জন্য রাধা আর বাড়ির বাইরে আসেন না। শাশুড়ি বা স্বামীকে তিনি আগের ঘটনাগুলো ভয়ে ও লজ্জায় খুলে বলেনি। 
এদিকে রাধাকে না দেখতে পেয়ে কৃষ্ণও কাতর। সে বড়ায়িকে দিয়ে রাধার শাশুড়িকে বোঝায়, ‘ঘরে বসে থেকে কি হবে, রাধা দুধ-দই বেচে কটি পয়সা তো আনতে পারে।‘
শেষে, শাশুড়ির নির্দেশে রাধা বাইরে বের হলেন। কিন্তু, প্রচণ্ড রোদে কোমল শরীরে দই-দুধ বহন করতে গিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। 
এই সময়ে কৃষ্ণ ছদ্মবেশে হাজির হন। বলেন, তিনি বয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু, পরে ভার বহন অর্থাৎ মজুরির বদলে তিনি রাধার আলিঙ্গন কামনা করেন। 
রাধা বুঝে ফেলেন কৃষ্ণের এই চতুরতা। কিন্তু, তাকে এই গরমে কাজটা আদায় করে নিতে হবে। তাই তিনিও কাজ আদায়ের লক্ষ্যে মিথ্যা আশ্বাস দেন। কৃষ্ণ আশায় আশায় রাধার পিছু পিছু ভার নিয়ে মথুরা পর্যন্ত চলেন।
 এরপর, ‘ছত্র খণ্ড’এ দুধ-দই বেচে মথুরা থেকে রাধার ফেরার পালা। কৃষ্ণ তার মুজুরি অর্থাৎ প্রাপ্য আলিঙ্গন চাইলেন। রাধা চালাকি করে বলেন, ‘এখনো প্রচণ্ড রোদ। তুমি ছাতা ধরে বৃন্দাবন পর্যন্ত চলো। পরে দেখা যাবে’। কৃষ্ণ ছাতা ধরতে লজ্জা ও অপমান বোধ করছিলেন। তবুও আশা নিয়ে ছাতা ধরেই চললেন। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ন করেননি রাধা।
কী মনে হচ্ছে? নিছক এক পরকীয়া প্রেম। শ্রীকৃষ্ণকে কী মনে হচ্ছে? নিজ কামনা চরিতার্থ করার জন্য সবকিছু করতে পারেন, এরকম এক যুবক। তাই না? মনে হচ্ছে, নারীরা মাঝে মাঝে কামনার কাছে তার সংসার-স্বামী সবকিছু ভুলে গিয়ে পরপুরুষের কাছে নিজেকে অনায়াসে নিবেদন করে বসেন তাই তো? কিন্তু, এ সবের আড়ালে আছে, এমন কিছু সত্য, যা বদলে দিতে পারে আপনার ভাবনাকে।
 রাধা কৃষ্ণের মামী ছিলেন, এটা বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যেই পাওয়া যায়। 

“সম্বন্ধ না মানে কাহ্নাঞিঁ মোকে বোলেঁ শালী। 
 লজ্জা দৃষ্টি হরিল ভাগিনা বনমালী 
 দেহ বৈরি হৈল মোকে এরুপ যৌবন। 
 কাহ্ন লজ্জা হরিল দেখিআঁ মোর তন – “ শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পৃষ্ঠা : ২০

 কিন্তু, এই প্রেম-তত্বের আড়ালে রয়েছে, এক ভিন্ন তত্ব যা ব্যাখ্যা করেছেন উইলিয়াম আর্চার ও ডেভিড কিন্সলি। এনারা হলেন ভারতীয় ধর্মীয় বিষয়ের গবেষক ও অধ্যাপক। হিন্দু দেব-দেবীর উপর তারা দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, যা আপনাদের এতদিনের ধারণাকে বদলে দেবে। চলবে

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad