বাবাজী মহারাজ চেয়েছিলেন ধর্ম ও সমাজ থেকে কুসংষ্কার তাড়াতে, বদলাতে চেয়েছিলেন সামাজিক কাঠামো, ফেরাতে চেয়েছিলেন মূল্যবোধ

বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন, কেউ যদি আমার কথাটা শুনে চলেন, তাহলে এক বছরের মধ্যে তার ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যাবে
বাবাজী মহারাজ বা দাদাগুরুজী মহারাজ (স্বামী শ্রীজানকীদাস কাঠিয়া) কিন্তু আচমকাই ধর্মের পথে আসেন নি। চারিদিক বুঝে শুনে, ধর্মের কথা শুনতে শুনতে, সন্ন্যাসী হলে লাভ বা লোকসান কী হয় বা মোহন্ত হওয়ার সুবিধা কী, এসব ভেবে ধর্মের পথে আসেন নি। 
আসলে তারা আসেন নি। ঠিকই শুনছেন। তারা আসেন নি। তাদের পাঠানো হয়েছিল এই ধরণীতে। তারা এসেছিলেন, ঈশ্বরের নির্দেশেই। মানুষের হিত সাধনের উদ্দেশ্যেই তাদের আগমন। তাই চেনা সন্ন্যাসীদের মতো তারা ছিলেন না। তারা ছিলেন অনেক, অনেক অচেনা। 
বাবাজী মহারাজ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষ প্রশ্ন করে, আপনারা এত জ্ঞানের কথা বলে যান, সমাজ বদলানোর কথা বলে যান, মূল্যবোধের কথা বলে যান, তাতেও তো কোন পরিবর্তন হয় না।‘ 
বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন – ‘আমরা আসি, বলি, তাতেও এই অবস্থা। আমাদের আসতে হয়। কেননা, আমাদের আসা বন্ধ হয়ে গেলে, আমাদের বক্তব্যকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে, সমাজ পিছিয়ে যাবে।‘
বাবাজী দেখিয়েছিলেন সন্ন্যাসীর জীবন – ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ – এরকম নয়। আচমকাই ইচ্ছে হলো জটা-দাড়ি রেখে সাধু হয়ে গেলাম, এটাও নয়। তার মতে, এই পথে আসতে গেলে আগে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যোগ্যতা অর্জন না করে কেউ এই পথে এলে তার কথার মধ্যে গাম্ভীর্য্য থাকে না। ফাঁকা আওয়াজ হয়ে যায় তার কথা।
 বাবাজী মহারাজ ওই সাক্ষাতকারে দ্বর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি গুরু হওয়ার জন্য আসেন নি। তিনি তার মত ও পথ, তার আদর্শ, কাঠিয়া সম্প্রদায়ের ভাবধারার পাশাপাশি তার গবেষণার বিষয়কে এই পৃথিবীর সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। বদলাতে চেয়েছিলেন সামাজিক কাঠামো, মূল্যবোধকে। তিনি চেয়েছিলেন মানুষ আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে চিনুন। নিজের অভ্যন্তরে বাস করা সেই ‘আমি’কে আবিষ্কার করুন। 

নীচের বইএর ছবিতে ক্লিক করে সরাসরি প্রকাশকের কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। 



আর সেই ‘আমি’কে খুঁজে পেলে আর গুরু লাগবে না। সেই ভিতরের ‘আমি’ মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে চলবে। এই বিষয়গুলো আমরা ধীরে ধীরে আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপিত করবো। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন যারা সমাজ বা ধর্ম সংষ্কারের পথে চলেন, তাদের জীবনটা কিন্তু সহজ হয় না। তাদের জীবনে প্রতি মুহুর্তে বাধা আসে। সেই বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। 
কুসংষ্কার এমন একটা বিষয়, যা মানুষের মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকে। এত গভীরে এর মূলটা থাকে যে টেনে উৎপাটন করা সম্ভব হয় না। আর যারা এই ধর্মীয় কুসংষ্কারের মূলকে তুলে ফেলতে চান, কিংবা তার একটা বিজ্ঞানসমত ব্যাখ্যা দিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তারা কিন্তু পরোক্ষে অনেকের শত্রু হয়ে যান।
কারণ, সমাজ এখনো নতুন ধারণাকে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়নি – এটা সত্য নয়। আসল সত্য হলো, এর পিছনে থাকে ভিন্ন একটা উদ্দেশ্য। তাই সমাজ ও ধর্ম-সংষ্কারককে নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, বা হয়েছিল। শ্রীচৈতন্যদেব বা যীশুখ্রীস্ট এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 
শুধু তাই নয়, নতুন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বহু দার্শনিক, বিজ্ঞানীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু, পরে জানা গেছে, তারাই ঠিক ছিলেন, আর যারা তাদের প্রাণ নিয়েছিলেন, তারা ভুল ছিলেন না, তারা নিজেদের কর্তৃত্ব হারাবার ভয় পেয়েছিলেন। তাই তাদের কণ্ঠস্বর বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু, এরা মৃত্যুর ভয়ে কণ্ঠস্বরকে লুকিয়ে ফেলেন নি। ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেখান থেকে তৈরি হয়েছে মহীরূহ। আমাদের এখন সেই মহীরূহরূপ সত্যের ছায়ায় নিশিন্তে আছি। 
এই প্রসঙ্গে বলি, বাবাজীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল – ‘পরের জন্য বাঁচা’ আর ‘আপনি আচরি ধর্ম, অপরে শেখাও’। অসাধারণ শক্তিশালী এই বাক্যগুলো। যারা এই বাক্যগুলির অন্তরালে মূল সত্যটাকে বুঝতে পারেন, তারা বুঝবেন বাবাজী কেন এসেছিলেন। কী করতে চেয়েছিলেন।

 

যারা চেনবার তারা ঠিক চিনেছিলেন বাবাজী আর দাদাগুরুজী মহারাজকে। যারা চিনতে পারেন নি, তাদের চিনতে দেন নি তারা। লক্ষ্য করে দেখবেন, একেবারে শৈশব থেকেই এনারা সাধারণের চেয়ে অনেক আলাদা ছিলেন। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। বাবাজী মহারাজের লেখা থেকে জানতে পারি জানকীদাসজী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভীষণ নির্জনতা প্রিয়।
 অন্য ছেলেরা যখন খেলা-ধূলায় মত্ত থাকত, দাদাজী মহারাজ তখন একান্তে কৃষ্ণ পুজো করতেন। বাড়ির কাছে জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে ভগবান কৃষ্ণের ফটো বসিয়ে পুজো করতেন। বনফুল তুলে। মালা গেঁথে বনমালীকে পরাতেন। 
কোন জায়গায় সাধু-সন্ন্যাসী এসেছেন শুনলে সেখানে হাজির হতেন। ছোটবেলা থেকেই বৈরাগ্য তাকে আশ্রয় করেছিল। তাই তিনি খুজে বেড়াতেন এমন সন্ন্যাসী যিনি এই পৃথিবীর বস্তুতে লালায়িত নন। আর সেই গুণটাই বাবাজী মহারাজ পেয়েছিলেন শ্রীজানকীদাসজীর কাছ থেকে।
কিন্তু, অদ্ভুত বিষয় হলো – এনারা শিক্ষাকে কোনদিন অগ্রাহ্য করেন নি। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করে গেছেন। কারণ, যারা সমাজ সংষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরণীতে আসেন, তাদের সঠিক শিক্ষা না থাকলে তো চলে না।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad