বিমলবাবুর দালানেই ঠিক হয়েছিল, বাবাজী মহারাজের ভবিষ্যৎ জীবনের উদ্দেশ্য

দুধে জল মেশানো হলে, জল যতক্ষণ না দুধের সাদা রঙকে আত্মস্মাৎ করতে পারছে, দুধ ততক্ষণই সাদা থাকে। দুধ হিসাবে সে যতই নিজেকে প্রচার করুক না কেন, দুধের গুণগত মানে সে কিন্তু নিকৃষ্ট।
সাধারণ এই কথাগুলো। এর অর্থ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন ভিন্ন রূপে ধরা দেবে। সোজা কথায় চটক দেখে ভুললে হবে না, গুণ বিচার করতে হাবে। সত্যিই দুধ পান করছি, না কি ‘জল মেশানো দুধ’ বা ‘দুধ মেশানো জল’ পান করছি দেখতে হাবে। 
রঙ দেখে ভুল করলেই বিপদ। অনেকে হয়ত বলতে পারেন, আগে রূপ বিচার করা উচিত, পরে গুণ। তাদের সবিনয়ে বলি, আমরা যেখানে গুণের কারণে যাব, সেখানে ‘গুণ’ বিচার করব, আর যেখানে রূপের টানে যাব, সেখানে রূপ বিচার করব।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা চালু আছে। কথাটা হলো – বিদ্যাসাগরের মতো চটী জোড়া পায়ে দিলেই কেউ বিদ্যাসাগর হয়ে যায় না। তার মতো বিদ্যার সাধনা প্রয়োজন, অধ্যয়ন প্রয়োজন। এই কথা বলার একটা কারণ, আমরা যেন সত্য আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে শিখি।
 ইংরাজীতেও একটা প্রবাদ আছে ‘All that glitters is not gold.’ অর্থাৎ চকচক করলেই সোনা হয় না। সোনার ধর্ম থাকা প্রয়োজন। আমাদের দাদাগুরুজী, বাবাজী মহারাজরা ছিলেন খনির সোনা। চকচক করার আগেই হোক বা পরেই হোক। 
এক নিখাদ সোনা তাই অনায়াসে চিনে নিতে পেরেছে আর এক নিখাদ সোনাকে। গ্রাম বড়র। মেমারী থানার অন্তর্গত ছোট এক গ্রাম। তখন একেবারেই গণ্ডগ্রাম। তবে এই গ্রামের একটা বৈশিষ্ট ছিল। সেটা হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান একসাথে নিশ্চিন্তে প্রতিবেশীর মতো বসবাস করত। তাদের মধ্যে কে হিন্দু, কে মুসলমান, নাম না বললে চেনাও যেত না।
 বাবাজী মহারাজ লিখেছেন – ওই গ্রামে ‘মহামিলন সমিতি’ নামে একটি ক্লাব ছিল। এই ক্লাবের সদস্য ছিল এলাকার হিন্দু- মুসুলমান। তারা সকলে মিলে যাত্রাপালার আয়োজন করত। ফলে গ্রামের মধ্যে ছিল একটা সুস্থ সাংষ্কৃতিক পরিবেশ।
সালটা ১৯৭৫, একেবারে শেষের দিকে। এই গ্রামেই পরিচয় হয় গুরু-শিষ্যে। আর তারপরই ঠিক হয়ে যায়, শিষ্যের ভবিষ্যৎ জীবন কোন দিকে প্রবাহিত হবে, পাওয়া যায় তার একটা পূর্বাভাস।
 দাদাগুরুজী মহারাজ তখন বৃন্দাবন আশ্রম ত্যাগ করে টাটানগরে এসে রয়েছেন। তিনি তখন ব্রজবিদেহী মহন্ত,   আবারও চতুঃসম্প্রদায়েরও মহন্ত। কিন্তু, এই শিল্প শহরের কোলাহল তার ভালো লাগত না। কারণ তিনি ছিলেন নির্জনতার বাসিন্দা। 
নির্জন স্থান তাকে বারবার ডাক দিয়ে যেত। টাটানগরের যান্ত্রিক জীবনে তিনি বন্দীত্বের আস্বাদ পাচ্ছিলেন। ভাবছিলেন কোথায় যাওয়া যায়, যেখানে গেলে তিনি পাবেন নির্জনতার স্বাদ। আনন্দে মেতে উঠতে পারবেন সাধন-ভজনে। এই শহরে শ্রীজানকীদাসজীর বেশ কিছু শিষ্য ছিল। তিনি তাদের বিষয়টা জানান। 
টাটায় তখন চাকরি করতেন নিরঞ্জন মজুমদার নামে এক ব্যক্তি। একসময় বাংলাদেশের সিলেট জিলার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আপনারাও জানেন শ্রীজানকীদাসজীর আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গে। নিরঞ্জনবাবু অসম্ভব ভালো ভাটিয়ালি গাইতেন। তার কন্ঠের যাদুতে যেন পদ্মা-মেঘনায় ঢেউ খেলা করতো। তার ভাটিয়ালি গানের উদাস সুরে দাদাগুরুজীও যেন হারিয়ে যেতেন শষ্য-শ্যামলা পদ্মা-মেঘনার দেশে। মানস চোখে দেখতে পেতেন গ্রাম-বাংলার অসামান্য রূপ।
নিরঞ্জনবাবু বললেন, তাদের গ্রাম বেশ নির্জন। তিনি ইচ্ছা করলে তাদের গ্রাম ঘুরে আসতে পারেন। কথাগুলো বলে তিনি শ্রীজানকীদাসজীকে তাদের বড়র গ্রামের ঠিকানা দিয়েছিলেন। কিন্তু, শ্রীজানকীদাসজী যে সত্যি সত্যি একদিন তাদের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়ে যাবেন, সেটা নিরঞ্জনবাবু ভাবতেও পারেন নি। 
কিন্তু, নিরঞ্জনবাবুর আর্থিক ক্ষমতা সেরকম ভালো ছিল না। যাইহোক, একদিন শ্রীজানকীদাসজী তার সঙ্গে জনা-দুএক লোক নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন বড়র গ্রামে। নিরঞ্জনবাবু ভাবতেই পারেন নি, সত্যি সত্যিই শ্রী জানকীদাসজী তার বাড়িতে হাজির হয়ে যাবেন। তিনি তো দিশেহারা। 
শেষপর্যন্ত তিনি শ্রীজানকীদাসজীকে নিয়ে হাজির হলেন বড়র গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু ভট্টাচার্য পরিবারের সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্যের বাড়ি। সিদ্ধেশ্বরবাবু দাদাগুরুজী মহারাজকে দুটি জমি দেখিয়েছিলেন আশ্রম করার জন্য। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন গুরু-শিষ্যে ছিল এক অসাধারণ মিল। আমাদের বাবাজী মহারাজ যখন নতুনগ্রামে আসেন, তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ঘোষাল পরিবার।

 নীচের বইএর ছবিতে ক্লিক করে সরাসরি প্রকাশকের কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। 


যাইহোক, দাদাগুরুজী তখনকার মতো বড়র ছেড়ে ফিরে যান লিলুয়ায়, তার এক গুরুভাইয়ের কাছে। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই বড়র গ্রামে আশ্রমের জমি রেজেস্ট্রি করে দিলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। বড়র গ্রামে এসে দাদাগুরুজী তখন বিমলবাবুর দালানে অবস্থান করছিলেন। 
বাবাজী মহারাজ তখন স্কুলের ছাত্র। তার এই আগমন বার্তা তার হৃদয়ে এক তীব্র আলোড়ন তুলল। কিন্তু কেন? তবে কি সবটাই পূর্ব-নির্ধারিত ছিল? একদিন শ্রীজানকীদাসজী আসবেন, সেখানে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় নামে এক কিশোরের দেখা হবে, ভবিষ্যতে, তিনি হয়ে উঠবেন স্বামী প্রজ্ঞাদাস। তাকে তিনি বলে যাবেন, তার এই পৃথিবীতে আসার কারণ কী।
বাবাজী মহারাজ ওই নবাগত সাধুকে প্রশ্ন করেছিলেন – মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? মানব জীবনের সার্থকতাই বা কোথায়? একটা বালক কী এই দূরূহ প্রশ্ন করতে পারে? সেদিন শ্রীজানকীদাসজী কীএই কথাটা ভেবেছিলেন? না কি, তিনি আশা করেছিলেন, প্রদীপ তাকে এই প্রশ্নগুলোই করবে? সব ঠিক ছিল। সব পূর্ব নির্ধারিত। সেদিন ঠিক হয়ে গিয়েছিল, এই ছোট্ট স্কুল-বালক সাধারণ নন, অসামান্য। আর সাধক প্রজ্ঞাদাসজী যে সত্যিই অসামান্য, তার আগমন যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সেদিন তার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad