তারক ঘোষ
তিনি বিশ্বাসী ছিলেন কর্মে, মুখের কথায় নয়। তিনি বিশ্বাসী ছিলেন সাম্য আর
আদর্শে, কুসংষ্কারে নয়। বাবাজী মহারাজ কী চেয়েছিলেন,
আর বাস্তবে কী হচ্ছে, তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তিনি শিষ্য করেছিলেন, যাতে তারা তার
অভিজ্ঞতা ও আদর্শ মেনে নিজেদের জীবন গঠন করেন। তিনি কখনো বলেন নি, তার আদর্শ ও বাণী
তার শিষ্যরা প্রচার করুক, কারণ, তিনি আত্মপ্রচারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু, একইসঙ্গে,
তিনি তার শ্রীগুরুর আদর্শকে প্রচার করার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শিষ্যদের প্রকৃত
কাজ কী হওয়া উচিত। কারণ, কোন মহামানবের আদর্শ ও জীবন-দর্শন পালন করার মধ্য দিয়ে একটা
সুন্দর-সুস্থ সামাজিক পরিবেশ জন্মলাভ করতে পারে। এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। বারে বারে
সে কথা বলে গেছেন, লিখে গেছেন।
শ্রীগুরুর দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে তার আদর্শ ও অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে
লড়াই শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু, অনেক মানুষ মনে করেন, শ্রীগুরুর কৃপা লাভের মূল পথ হলো
‘জয়গুরু’ বলে দায় সারা। চোখের সামনে অন্যায় ও অধর্ম দেখলেও তারা বাবাজীর মতো প্রতিবাদ
করতে ভয় পান।
অনেকে মনে করেন, মঠ ও মন্দির তৈরিরর মধ্য দিয়েই গুরুকে পাওয়া যায়। বাবাজী
মহারাজও মন্দির নির্মান করেছিলেন, কিন্তু, তা ছিল নিম্বার্ক সম্প্রদায় ও তার শ্রীগুরু
আদর্শ প্রচারের কেন্দ্র। সেখানে থেকেই তিনি চালিয়ে গেছেন প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজ। শ্রীগুরুর
আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ তৈরি না করে, শুধু, ‘অর্থ উপার্জনের’ জন্য মন্দির করলে, ব্যক্তিগত
লাভ হতে পারে, কিন্তু সমষ্টির কিছু লাভ হয় না। অথচ বাবা সারাটা জীবন এই সমষ্টির কথাই
ভেবেছিলেন। ব্যক্তি লাভের কথা ভাবেন নি।
বাবার জীবনই তার সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী – এই কথাটা যারা মনে রাখেন, তারা ‘জয়গুরু
বা জয় রাধে’ না বলে, বাবার কাজ ও বাণীকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে বেশি বিশ্বাস রাখবেন বলেই
আমরা মনে করি। বাবার কাছে দীক্ষা নিয়েই বিরাট কিছু হয়ে গেছি – এই ভাবটা নিজেদেরই ঠকানো।
কারণ, বাবাজী অসমের একটি দূর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে গিয়ে চন্ডীতত্ব নিয়ে কথা বলার সময় বলেছিলেন,
নিজেকে ভক্ত ভাবাটাও অহঙ্কার। মা এই অহঙ্কারকেও দূর করে দেন। কারণ বাবার দেওয়া শিক্ষা
যদি পালন না করি, তাহলে কী করলাম! শুধু পুজো! এই কথা গুলো বাবার কথারই প্রতিধ্বনী।
এগুলো আমার কথা নয়, কারণ আমি ভক্ত নই, আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, ন্যায়
ও অন্যায় এর পার্থক্যটা বুঝি, ধর্ম ও অধর্ম কী, সেটাও বুঝি। আমাদের বাবাজী এই অধর্মের
বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করেছেন, ন্যায় এর পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন আর তার মন্ত্রশিষ্য হয়ে
এই কথাগুলোই যদি না মানি, তাহলে আমার ‘জয়গুরু’ বলার কোন অধিকার থাকতে পারে না। কারণ,
শ্রীগুরুর কথা না শুনে, তার আদর্শকে ভুলে গিয়ে, বা পালন না করে, আমি শ্রীগুরুকে দেবতা
সাজিয়ে পুজো করলে, সেটা নিজেকেই ঠকানো হয়।
বাবাজী মহারাজ বলছেন, আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য ভুলে যাচ্ছি। মূর্তি পূজার
নামে প্যান্ডেল বানিয়ে মদ পান করছি। উচ্ছৃঙ্খলতা করছি। এটা সনাতন ধর্ম নয়।‘ বাবার এই
কথা চরম ভক্তির সঙ্গে শোনাউল্লারা শুনে যায়, কিন্তু অনেকেই তা পালন করেন না।কারণ পালন
করা আর শোনার মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য আছে, এর জন্য মনের বল লাগে, মেরুদণ্ড লাগে,
এটা বাবা বুঝে গিয়েছিলেন বলেই বলতে পেরেছিলেন –‘করিমউল্লা’ কেউ নেই।‘
এটা বাবার অভিমান নয়, এটা উপলব্ধি। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, যোগ্য শিষ্য পাওয়া
কঠিন। তাই বলেছিলেন – যে সাধুজী সব ছেড়ে আবার শিষ্য-শিষ্যাদের পুজো পেতে পেতে, অসার
স্তোকবাক্য শুনতে শুনতে নিজেকে ঈশ্বর ভেবে ফেলেছে, সে কি আবার এই অসার সুখ ছাড়বে।‘
বাস্তব তাই বলে, শিষ্য গুরু হলেও, তার মধ্যে শিষ্যভাব রাখতে হয়, কিন্তু
এখন সবাই অতি সহজেই গুরু হয়ে যাচ্ছেন।
চাকরি-বাকরির যোগ্যতা নেই, শিক্ষা নেই, কী করা যাবে? চলো কোন সাধুজীর চেলা
হয়ে যাই, পরে একদিন গুরু হয়ে বসে পড়বো। গুরু হতে গেলে শিষ্যকে দেওয়ার মতো জ্ঞান, শিক্ষা
অর্জন করতে হয়, কাম-ক্রোধ-লোভ ছাড়তে হয়, এই বোধটাও তাদের থাকে না। বহু ‘গুরু’ তো এইরকম
কামিনী-কাঞ্চনের লোভে এখন গরাদের আড়ালে চলে গেছে। যাবজ্জীবন খাটছে। সম্পত্তির লোভে
হত্যা করতেও তাদের হাত কাপেনি। এরা আবার ‘ধর্মগুরু’ বলে নিজেদের প্রচার করত, আর বোকা
কিছু মানুষ না জেনে এদের ফাঁদে পা দিত।
বাবাজী বলছেন- আমাদের পরম্পরা মঠ-মন্দিরের পরম্পরা নয়, এটা সাধন-ভজনের স্থান।
কিন্তু, বাস্তব অনেক সময় ভিন্ন কথা বলে। মাঝে মাঝে ভিডিওতে দেখি, কী চলছে সমাজে। বাবা
বলছেন –জীবনে আদর্শ নির্বাচনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আজ কোথায় আদর্শ? আমরা শুধু
জয়গুরু বলেই ক্ষান্ত। এর বাইরে মুখে আর কোন বুলি নেই। আবার এমন কিছু মানুষ-জন আছেন,
যারা মনে করেন, বাবার ছবি সাদা-কালো দেখলে, বাবাজী না কি তাকে ছেড়ে চলে যান। যে যা পারছেন
বলে যাচ্ছেন। অশিক্ষাকে, কুসংষ্কারকে সমাজ থেকে দূর করতে চেয়েছিলেন বাবাজী মহারাজ,
আর তার কাছে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই সেই কুসংষ্কারের দাসত্ব করছে। বাবাজীর দাসত্বিব করলে, তারা এটা করত না। তারা বিশ্বাস করছে দেব-দেবীর
ভর হওয়াতে। বাবা কী ধরণের গুরুদেব ছিলেন, সেটাই কেউ জানতে চেষ্টা করলো না। আর এটাই
ছিল বাবার আক্ষেপ।
বাবাজী
দেখেছিলেন একশ্রেণির ধর্মীয় মানুষদের পদ ও ক্ষমতার লোভের জন্য তার শ্রীগুরুকে
পর্যন্ত অসম্মানিত হতে হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন একশ্রেণির ‘সাধু’দের হানাহানি সমাজে কতটা বিপজ্জনক
প্রভাব ফেলে। তিনি দেখেছিলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা
গোপন হিংসা থেকে মুক্ত নয় সাধু সমাজের একটা অংশ। এসব তাকে ব্যথিত করত।
তিনি ছিলেন প্রতিবাদী মহামানব,
যুগপুরুষ, তাই মুখে না বললেও, তিনি চাইতেন তার এই ধরণের শিষ্য-সমাজ গড়ে উঠুক, যারা
তার আদর্শকে বহন করে নিয়ে যাবে। কিন্তু…