কেন ইউরোপ জুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ? শুধুমাত্র স্পেন, পর্তুগালে ১৯০০ এরও বেশি মানুষের মৃত্যু


তারক ঘোষঃ
ঠিক ১৯ বছর আগে ২০০৩ সালে ইউরোপ তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছিল। মারা গিয়েছিলেন ৭০ হাজার মানুষ। আজ ২২ বছর পর ইউরোপবাসী আবার এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তাপমাত্রা স্বাভাবিকে চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল ও গ্রিসের বনাঞ্চলে আগুন ধরে গেছে। জ্বলছে ইংল্যান্ডের বাড়ি, গলছে ব্রিটেনের সড়ক ও রেলপথ। ইতিহাসে এই প্রথম ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার করল পারদ। মহাদেশজুড়ে প্রাণ হারালেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর পশ্চিম ইউরোপ থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়া তাপপ্রবাহ বাকি বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি। তাই ইউরোপ পৃথিবীর অন্য অংশের তুলনায় খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। দু মাস আগে, ফ্রান্সের তাপমাত্রা বেড়ে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। মে মাসে ফ্রান্স উষ্ণতম রেকর্ডের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। গত মাসে, ফ্রান্স আবার আক্রান্ত হয়েছিল তাপপ্রবাহে। এখনো পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় নি। চলতি মাসে, পোল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে শুরু হয়েছে তীব্র দাবদাহ। পুড়ছে বনাঞ্চল। এখন ইউরোপ জুড়ে তাপমাত্রা আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্পেন থেকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে এবং পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দেশেই তাপপ্রবাহের কারণে দাবানল জ্বলছে, এবং মহাদেশের বেশিরভাগ অংশ দীর্ঘ খরার কবলে পড়েছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো গ্রীষ্মের এখনও দুই মাস বাকি আছে।
অবস্থা বেশ ভয়াবহ। যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন এলাকায় তাপপ্রবাহের জন্য লাল সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া দফতর। গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ট্রেন পরিষেবা, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ। স্পেনের কার্লোস ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দাবানলে ৮৬২ জন নিহত হয়েছে। ১৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। এ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে ৭০ হাজার হেক্টর বনভূমি। গত ১৭ জুলাই পর্তুগালে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে গিয়ে একটি অগ্নি নির্বাপক বিমান বিধ্বস্ত হয়। এ পর্যন্ত তাপপ্রবাহজনিত ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১১০০ জন। তাপপ্রবাহের কারণে, এ বছর জার্মানিতে মানুষ খরার কবলে পড়তে পারে। অন্যদিকে, বেলজিয়াম ও সুইডেনে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় 'রেড' ও 'অরেঞ্জ' সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দাবানলের কারণে ইতালিতেও হাই অ্যালার্ট জারি রয়েছে।
কিন্তু কেন এই তীব্র তাপ?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বছর ইউরোপে ধারাবাহিকভাবে তাপ বৃদ্ধির একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা কিন্তু বিশ্বের অন্যন্য অংশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা বলছেন, এক্ষেত্রে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটি ভূমিকা পালন করেছে, যেমন এটি বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে করে। কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য তাপ-ট্র্যাপিং গ্যাসের নির্গমন ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় ১৯ শতকের শেষের দিকে তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি। এছাড়া অন্যন্য কারণের মধ্যে আছে - জেট স্ট্রিম: পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডলে দ্রুত প্রবাহিত বায়ু (জেট স্ট্রিম) পরিবর্তন রয়েছে, যা ইউরোপে তাপ বাড়িয়ে তুলছে। ২০০৩ সালেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

 
নিম্ন চাপ অঞ্চল: বায়ু উচ্চ চাপ থেকে নিম্ন চাপ এলাকায় প্রবাহিত হয়। এ ক্ষেত্রে উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে হাওয়া বইছে। পর্তুগালের উপকূলের (নিম্নচাপ অঞ্চল) আশপাশে বেশ কয়েকদিন ধরেই গরম হাওয়া ঘোরাফেরা করছে। 
সামুদ্রিক তাপ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্কটিক মহাসাগরের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এখানে গরমের প্রভাব দেখা যায় ইউরোপে বয়ে যাওয়া বাতাসে। এখন তাপপ্রবাহ একই জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরে বেড়ায়। 
মাটির শুষ্কতা: ইউরোপের বেশিরভাগ অংশের মাটিতে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকে। অর্থাৎ এখানকার মাটি খুব একটা তাপ শুষে নেয় না, যার ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। 
জার্মানির পোটসডাম ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট রিসার্চের সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং গবেষক ইফি রুসি বলেছেন, বর্তমান তাপপ্রবাহটি এমন একটি "ডাবল জেট" এর সাথে যুক্ত বলে মনে হচ্ছে, যা গত দুই সপ্তাহ ধরে ইউরোপে রয়েছে। ডঃ রুসি বলেন, এর ফলে কাটঅফ কম তৈরি হতে পারে, পাশাপাশি ইউরোপের উপর দুর্বল বাতাসের একটি অঞ্চল তৈরি হতে পারে যা তাপকে অব্যাহত রাখবে। এটা সত্য, আজ ইউরোপ জুড়ে চলছে এই তীব্র তাপপ্রবাহ, এশিয়ার মানুষ যদি দূষণ সম্পর্কে সতর্ক না হয়, কিংবা দেশের সরকার যদি দূষণ প্রতিরোধে আরও কঠোর না হয়, প্রকৃতি কিন্তু ক্ষমা করবে না। 

 ফটো সৌজন্যঃ এ পি, দি আটলান্টিক, ইন্সাইডারকম, এন পি আর

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad