এ আর এক জালিয়ানওয়ালাবাগঃ ১৯২১ সালে এখানে ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ৭৫০ জন নিরীহ কৃষক

স্বাধীনতা সংগ্রামী অনিল মিশ্র বলছেন, 'এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে গুলি চালানোর ১০০ বছর পরেও এই শহিদ স্থানটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের মর্যাদা পায়নি। আমাদের সংগঠন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে, যাতে এটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের মর্যাদা পায়।“ 

 তারক ঘোষ

"আসুন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে এদের আমরা শ্রদ্ধা জানাই" সংবাদ ভয়েস ৯

জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা। যার কথা শুনলে আজও ভারতীয়রা শিউরে ওঠেন ব্রিটিশ সরকারের নির্মমতার কথা ভেবে। জালিয়ানওয়ালাবাগ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যে জন্য তার নাইটহুড উপাধি হেলায়ত্যাগ করেছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ। যেখানে কান পাতলে আজও শোনা যায় নীরব মানবতার কান্না। জালিয়ানওয়ালাবাগ। যাকে অমৃতসরের গণহত্যাও বলা হয়, তা সংগঠিত হয়েছিল ১৯১৯ সালের ১৩ ই এপ্রিল। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে পরিচিত একটি খোলা জায়গায় নিরস্ত্র ভারতীয়দের একটি বিশাল সমাবেশের উপর গুলি চালিয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী, যার ফলে কয়েকশ ভারতবাসী নিহত হয়েছিলেনএবং আরও শত শত আহত হয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার মানুষের সমাবেশে সেদিন গুলি চলেছিল জেনারেল ডায়ারের নির্দেশ। রক্তে ভেসে গিয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা। 



 আজ আর এক জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা বলছি, যেখানে নিহত হয়েছিলেন ৭৫০ জন নিরস্ত্র কৃষক। ঘটনাটি ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রায় ২ বছর পর, ১৯২১ সালের ৫ জানুয়ারী। উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জ এলাকা। এখান দিয়ে বয়ে গেছে সাই নদী। সেদিন সাই নদীর জল হয়ে উঠেছিল রক্ত-লাল। সেদিনও প্রতিবাদের ভাষাকে রক্তে স্নান করিয়েছিল ব্রিটিশ-রাজ। নির্মমতার আর এক দলিল সেদিন তারা লিখেছিল। সেদিন এখানে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ২০০০ কৃষক। এই লড়াই ছিল ব্রিটিশদের অবৈধ ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে। কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তারা সেদিন প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলেন নিরস্ত্র অবস্থায়।   কিন্তু, ব্রি্টিশ পুলিশ তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালা। ২৫ ফুট উচু থেকে অনেকেই লাফ দেন সাই নদীতে। সেখানেও তাদের উপর গুলি চলে। নদীর বুকে ভেসে উঠতে থাকে একের পর এক মৃতদেহ। সেদিন ৭৫০ জন কৃষক শহীদ হন এবং ১৫০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হন। স্বাধীনতার ইতিহাসে এই ঘটনার নাম ছিল 'মুন্সীগঞ্জ ফায়ারিং ইনসিডেন্ট'। ভয়াবহ এই গণহত্যাকে 'দুসরা জালিয়ানওয়ালাবাগ' বলে অভিহিত করেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাংবাদিক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী। 



জানা গেছে, সেই সময় বেআইনি কর আদায় নিয়ে কৃষকরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ব্রিটিশদের উপর বিরক্ত হয়ে ১৯২১ সালের ৫ জানুয়ারি কৃষক নেতা অমল শর্মা, বাবা রামচন্দ্র ও বাবা জানকী দাসের নেতৃত্বে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে কৃষকরা এই সভায় অংশ নিতে এসেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের ডেপুটি কমিশনার এজি শেরিফ ওই তিন কৃষক নেতাকে গ্রেফতার করে লখনউ জেলে পাঠান। এর দু'দিন পর, ১৯২১ সালের ৭ জানুয়ারি রায়বরেলিতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, লখনউয়ে এই তিন নেতাকে খুন করা হয়েছে। এই কথা শুনে সাঁই নদীর পাড়ে জড়ো হন ২০০০-রও বেশি কৃষক। কৃষকদের ভিড় দেখে ব্রিটিশ অফিসার শেরিফ আতঙ্কিত হয়ে নিরস্ত্র কৃষকদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এরপর, রায়বরেলির পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে তৎকালীন নেতা মার্তন্দ দত্ত বৈদ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে অবিলম্বে মুন্সিগঞ্জে আসতে বলেন। নেহরু দিল্লি থেকে ট্রেন ধরে পরের দিন সকালে রায়বরেলি পৌঁছন। তবে কালেক্টরেট চত্বরের কাছে তাদের থামানো হয়েছিল। কোনওরকমে সাঁই নদীর সেতুতে পৌঁছে গেলেও ব্রিটিশরা তাঁদের আটকে রেখে গৃহবন্দি করে রাখে। 



এর ছয় দিন পর, ১৯২১ সালের ১৩ জানুয়ারি কানপুর থেকে দৈনিক প্রতাপ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক শিরোমণি গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী 'রায়বরেলি কি দয়রশাহি' শিরোনামে এই গণহত্যার কথা প্রকাশ করেন। তিনি এই ঘটনাকে 'মিনি-জালিয়ানওয়ালাবাগ' বলে অভিহিত করেছিলেন। এই খবরে ব্রিটিশরা বিদ্যার্থীজির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেছিল। রায়বরেলির স্বাধীনতা সংগ্রামী পণ্ডিত মদনমোহন মিশ্র শহীদ কৃষকদের স্মরণে সাই নদীর তীরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। নাম মুন্সিগঞ্জ শহীদ স্মৃতিসৌধ। ১৯৮৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এর উদ্বোধন করেন রাজীব গান্ধী। এরপর থেকে প্রতি বছর ৭ জানুয়ারি এখানে শহীদ কৃষকদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামী অনিল মিশ্র বলছেন, 'এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে গুলি চালানোর ১০০ বছর পরেও এই শহিদ স্থানটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের মর্যাদা পায়নি। আমাদের সংগঠন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে, যাতে এটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের মর্যাদা পায়।“
ইনপুটঃ দৈনিক ভাষ্কর

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad