পড়া হয়ে গেলে, তিনি বই এর পাতাগুলি ছিঁড়ে ফেলতেন

ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছোট্ট সত্যেন্দ্রনাথ কে তাঁর মা বলতেন একি! বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেললি! সত্যেন বলতেন 'পড়া তো হয়ে গেছে৷ বুঝে গেছি তো'৷ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কি অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন সেসব কথা নতুন করে বলার কিছু নেই৷ সুরেন্দ্রনাথ বসু ও অমোদিনী দেবীর সাত সন্তানের একমাত্র পুত্র 'বোদের' দুষ্টুমি বন্ধ করার জন্য তাঁর বাবা গুদাম ঘরের সিমেন্টের মেঝেতে অঙ্ক দিয়ে যেতেন,বালক মহানন্দে দুষ্টুমি ভুলে সেই অঙ্ক করত৷ স্কুলের অঙ্কের পরীক্ষায় একশোতে একশো দশ পাওয়া ছোট্ট সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্র জীবনেরই ঘটনা৷ প্রবেশিকা পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু ইতিহাস-ভূগোলে খুব ভাল নম্বর পেয়েছিলেন বলে তাঁর বাবা ছেলে কে আর্টস পড়তে বলেছিলেন৷ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই তিনি যদি আর্টস পড়তেন তাহলে আমরা কিন্তু বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কে পেতাম না৷ ছাত্রদের বেশি নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক পার্সিভাল সাহেবের সুনাম খুব একটা ছিল না৷ তিনি কাউকে ষাটের বেশি নম্বর দিতেন না সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ কে ইংরেজিতে ৭০দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর ছাত্রের অসাধারণ মেধার জন্য৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় আইনস্টাইনের কাছে গবেষণাপত্র পাঠিয়ে সত্যেন বসু স্বীকৃতি লাভ করেন৷ কিন্তু গবেষণাপত্র থাকলেও ডক্টরেট ডিগ্রি নেই৷ অধ্যাপক পদ লাভের জন্য বড় বাধা৷ শংসাপত্র দিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন৷ এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন বসু রিডার থেকে অধ্যাপক হয়েছিলেন৷
পশুপতি ভট্টাচার্য ছিলেন বাগবাজারের খ্যাতনামা চিকিৎসক এবং সাহিত্যিক৷ তাঁর ভাই গিরিজপতি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহপাঠী৷ দাদার মত ভাই সাহিত্য চর্চা করতেন,ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞান গবেষক৷ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ক্যালকাটা সোপ ওয়ার্কসে 'নিমলিন' 'ডালি', 'বাংলা গোলা',নামে কয়েকটি জনপ্রিয় সাবান তৈরি করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ কে তিনি যে সাবান তৈরি করে দিয়েছিলেন কবি তাঁর নাম দিয়েছিলেন 'তরলিকা'৷ গিরিজাপতি ভট্টাচার্যের লেখায় পাওয়া যায় সত্যেন বসুর বন্ধু প্রীতির কথা৷ একবার তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলে তাঁর ব্যবহারে ও মর্মস্পর্শিতায় কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারতেন না৷ তিনি ছিলেন সুরসিক,সুলেখক,মরমী ও মানবদরদী৷ সত্যেন্দ্রনাথ বসু বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে অথবা নতুন বন্ধুত্ব স্থাপনে কলকাতার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত চলে যেতেন হেঁটে৷ তখন বালিগঞ্জে ট্রাম চলত না,বাস চালু হয় নি৷ একজন বন্ধুকে সঙ্গে এনে অপর বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন৷
সত্যেন বসু'র জীবনের বেশ মজার দুটি ঘটনার কথা একটু বলতে ইচ্ছা করছে৷ একবার সাহা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক নীলস বোর ভাষণ দিচ্ছেন৷ সামনে আসীন ক্লান্ত মুদ্রিত চোখে চক্ষু সত্যেন্দ্রনাথ যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু লিখতে গিয়ে অধ্যাপক বোর বললেন 'মনে হয় অধ্যাপক বসু আমাকে সাহায্য করতে পারেন'৷ তৎক্ষণাৎ সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর চোখ খুলে গানিতিক জটটির সমাধান ব্যাখ্যা করে আবার চোখ বুঝিয়ে দিলেন৷ ওই সাহা ইনস্টিটিউটে ফ্রেডরিক জোলিও কুরীর এক অনুষ্ঠানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু সভাপতি৷ অধ্যাপক জোলিও তাঁর ফরাসী ভাষায় প্রদত্ত বক্তব্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য সভাকক্ষে অনুবাদকের সমাধান চাইলেন৷ কেউ এগিয়ে এলেন না দেখে সত্যেন্দ্রনাথ সেই ফরাসী ভাষার বক্তৃতাকে বাক্যের পর বাক্য অনবদ্য ইংরেজিতে বলে যেতে লাগলেন৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি ঠিক কতটা দুরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন সেকথা জানা যায় অশোক মিত্রের স্মৃতিচারণায়৷ ১৯৫০ সালের শেষ দিক,খড়গপুরে প্রফেসর সত্যেন বসু ট্রেনে উঠেছেন, গিয়েছিলেন খড়গপুর আই আই টি তে ৷ আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ৷ এর কিছুদিন আগে তিনি ফিরেছেন ইউরোপ থেকে৷ অশোক মিত্রের সাথে দেখা৷ তাঁকে সত্যেন বোস বললেন জানো অশোক যে-সব সাইমালটেনিয়াস ইকোয়েশন কষতে আমরা পনেরো দিন ধরে হিমসিম খেতুম সেইসব ইকোয়েশান কম্পিউটারে পুরে দিলে মিনিটের মধ্যে কষে বেরিয়ে আসে! আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মানুষ কী যে করতে পারবে না,তাই ভাবি৷ অধ্যাপক সত্যেন বসুর কথা কিন্তু অক্ষরে -অক্ষরে ফলে গেছে৷ বোঝা যায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি ঠিক কতটা সুনিশ্চিত ছিলেন৷
ভারতীয় বিজ্ঞান নতুন অধ্যায়ে পদার্পণ করেছে প্রধানত দুজন কে কেন্দ্র করে৷ জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র সেই দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র৷ এরপরে এমন কয়েক এসেছিলেন বলা যেতে পারে স্বাধীনতার পরে তাদের হাতে ভারতের বিজ্ঞান পরিকাঠামো রচিত হয়েছে৷ তালিকায় নাম গুলি সত্যেন্দ্রনাথ বসু,মেঘনাদ সাহা,জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ,জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আরও অনেকে৷ সহপাঠী এই বন্ধুদের বিজ্ঞান প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে ৷ছাত্রকুলে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সকলের সেরা যদিও কম যান নি মেঘনাদ৷ সংকলনে—অরুণাভ সেন ©ভালবাসি বাংলা গ্রন্থঋণ,চিত্রঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু,সংকলন ও সম্পাদনা,শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad