প্রবাসে পুজোঃ অ্যান আর্বার, মিচিগান এ 'স্বজন' পরিচালিত দুর্গাপুজো


অ্যান আর্বার, মিচিগান থেকে সুপ্রতীম ঘোষ

 শহরের টোসলে অডিটোরিয়ামে কতরকম সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করে এখানকার বাঙালি, পাঞ্জাবীরা। ভারত বা বাংলাদেশ নেই, এখানে সবাই বাঙালি। আর আছে ‘স্বজন’। সুদূর এই শহরে বসে ‘পাঠশালায়’ বাংলা শেখে এখানকার খুদে বাঙালিরা।

ন্যু-ইয়র্ক সিটি থেকে সড়কপথে অ্যান আর্বার ৬১৯ মাইল। সাড়ে আট ঘন্টা বা ৯ ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাওয়া যায় এই সুন্দর শহরে। লেক মিশিগান, হুরন নদী। ওখানে যেমন হাডসন, এখানে হুরন। অ্যান আর্বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের একটি শহর। অ্যান আর্বার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮২৪ সালে। শহরের নাম রাখা হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতাদের স্ত্রীদের নামে। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিলাম সান্দ্রাকে নিয়ে অ্যান আর্বার এর পথে। ডেট্রয়েটে থাকে আমার ছেলে কিন্নর। আমার মতো ও বিয়ে করেছে এক কানাডিয়ানকে। মেয়েটা বড়ো ভালো। একসময় ওর বাবা বেশ কয়েক বছর ভারতে কাটিয়েছিল। সেই থেকেই ভারতের প্রতি ওর ভালোবাসা। 

ওদের নিয়ে একবার দেশে এসেছিলাম। ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম বেলুড় মঠ, দক্ষিনেশ্বর। খুব খুশি হয়েছিল, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ঠিক আমাদের নেলসন নদীর মতো। গাড়ি চালাতে চালাতে সান্দ্রাকে বলেছিলাম, ভারতে থাকবে বাকি জীবনটা? ও, মুখের উপর থেকে উড়ন্ত চুল সরিয়ে বলেছিল, আমাদের আর নিজের দেশ কী, যেখানে ভালো থাকবো, তাকেই আপন করে নেবো। মেয়েদের আর দেশ বলে কিছু নেই। 
দুপুরের পর পৌঁছে গেলাম অ্যান আর্বার শহরে। এখানে আমার এক বন্ধু থাকে। সাহিল। ঢাকায় বাড়ি। আগে আমার সঙ্গে ম্যানহাটনে থাকত, তখন আমার বিয়ে হয়নি। ইচ্ছে আছে সাহিলের কাছেই পুজোটা কাটাবো। ও খুব দিলখোলা। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি নেই। 

এবার আসি এখানকার দুর্গাপুজোর কথায়। এই শহরেও এক মিনি ভারত খুঁজে পাওয়া যায়। শহরের টোসলে অডিটোরিয়ামে কতরকম সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান করে এখানকার বাঙালি, পাঞ্জাবীরা। ভারত বা বাংলাদেশ নেই, এখানে সবাই বাঙালি। আর আছে ‘স্বজন’। ২০১৭ সালে তরুণ কোটাল আর উত্তরা মুখার্জীর উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল এই ‘স্বজন’। শুনলে অবাক হবেন, এরা হুগলি জেলার পুড়শুড়াতে গরীব ছাত্রদের নানা সাহাজ্য পাঠায়। সুদূর এই শহরে বসে ‘পাঠশালায়’ বাংলা শেখে এখানকার খুদে বাঙালিরা। ‘স্বজন’ এই বাংলা পাঠশালার শুভারম্ভ করে এক ১ লা বৈশাখে। এটা সম্পুর্ণ অবৈতনিক বাংলা পাঠশালা। স্বজনের সদস্য-পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যই মুলত এই উদ্যোগ। এর লক্ষ্য হলো বাচ্চাদের বাংলায় কথা বলাতে উৎসাহ বাড়ানো, এর সাথে সাথে বাচ্চারা যাতে বাংলায় গল্প, গান কবিতা বুঝতে পারে এবং তাতে উৎসাহিত হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। 


আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যখন বাংলার চেয়ে ইংরাজীকে প্রাধান্য দেয়, এরা এই এত দূরে থেকে বাংলাকে না ভুলে যাওয়ার আয়োজনে মেতেছে। ভালো লাগে। আমার বন্ধু সাহিলের নাতনি মিশি তো কাজী নজরুলের কবিতা আবৃতি করে শুনিয়ে দিল। এবারের স্বজন পরিচালিত অ্যান আর্বার এর দুর্গাপুজায় ও কবিগুরুর ‘হারিয়ে গেছি আমি’ কবিতাটা শোনাবে। পুজোয় সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘স্বজন’। 


আর কী না করে স্বজনের সদস্যরা! ১ লা বৈশাখ, বাংলা ভাষায় ‘স্বজন’ নামে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ, ক্যান্সার রোগীদের সাহায্য-সেবা, আহত বন্যপ্রাণীদের যত্ন নেওয়া- নানা সেবামূলক কাজ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দের সঙ্গে সমাজসেবা করে। এই শহরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করে স্বজন। প্রতি বছর ৩০ শে সেপ্টেম্বর থেকে ২ রা অক্টোবর। এ বছরও সেই একই দিনগুলিতে। তিনিদিনের অনুষ্ঠানে মেতে উঠবে এখানকার বাঙালিরা। বোধন থেকে বিসর্জন। মনে হবে, আমরা যেন বসে আছি বাংলার কোন পুজো-মন্ডপে। আসলে কিছুই হারায় না। বাঁচিয়ে রাখার পাস-ওয়ার্ড জানা চাই। 



এবারেও পুজো হবে অ্যান আর্বার, এমআই-এর ওয়াশটেনাউ কমিউনিটি কলেজের টোসলে অডিটোরিয়াম এ । প্রতি বছর প্রায় ৫০০-৬০০ মানুষ পুজো দেখতে আসে। এবার সেই সংখ্যাটা ৬০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। থাকছে পুজোর দিনিগুলির জন্য স্পেশাল মেনু, খিচুড়ি ভোগ, পায়েস। সব। পুজোর দিনগুলিতে নেই পড়াশোনা, শুধুই আনন্দ। হুরন নদীর খোলা হাওয়ায় ভেসে যাওয়া। সব আছে এখানে, নেই দামোদরের উপর দিয়ে ভেসে চলা সেই ডিঙ্গি নৌকো আর মাঝির গলায় সেই ভাটিয়ালি!

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad