তারাপীঠে আজ মা তারার পূণ্য আবির্ভাব তিথিঃ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে লক্ষ লক্ষ ভক্ত

রজত রায়, তারাপীঠঃ করোনা অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছিল। আজ তারাপীঠে পৌছে এ কথাটাই প্রথমে মনে হল। আমি এসেছিলাম ট্রেনে, শিয়ালদহ রামপুরহাট এক্সপ্রেস। প্রচণ্ড ভিড়। গন্তব্যস্থল তারাপীঠ। মা তারার আজ পূণ্য আবির্ভাব তিথি। তাই কোনো বাধাই বাধা নয়। আর ট্রেনের ভিড় তো সামান্য ব্যাপার। সব পথ আজ মিশেছে সাধন-ক্ষেত্র তারাপীঠে। উপচে পড়ছে ট্রেন, বাস। এমনকি মোটর-ভ্যানে চেপে আশপাশ গাঁয়ের পুণ্যার্থীরা চলেছে মা তারা আর সাধক বামা খ্যাপার সাধন তীর্থে।


 তারাপীঠ রোড স্টেশনে নেমে দেখা হয়েছিল ঠাকুর মশাইয়ের সঙ্গে। থাকেন উত্তর ২৪ পরগণার এক ছোট্ট গ্রামে। এই দিনটিতে তার আসা চাইই। তিনি বললেন, আজ মাকে আমরা দেখব লক্ষীরূপে। কথায় কথা তিনি জানালেন, বশিষ্ঠ মুনি মা তারাকে স্বপ্নে দেখতে পান। সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তি মাটির নীচে প্রথিত ছিল বহু শতাব্দী। বাংলায় তখন পাল বংশ। এই সময় জয় দত্ত নামে এক সদাগর শ্মশান থেকে মায়ের সেই মূর্তি তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। সেদিন ছিল শুক্লা চতুর্দশীর রাত। আজ সেই শুক্লা চতুর্দশী, মায়ের আবির্ভাব তিথি। আজ মা থাকবেন পশ্চিমমুখী আসনে। উল্লেখ্য, তারামা থাকেন উত্তরমুখী আসনে। ঠাকুর মশাই একটা গান ধরলেন, শ্যামাসঙ্গীত। সাধক রামপসাদের “আমি তাই কালো রূপ ভালোবাসি…” গান থামিয়ে ঠাকুরমশায় বললেন, জানেন, আজ আমার মাতারা মন্দিরে থাকবেন না। প্রাচীন রীতি মেনে আজ সকালে মা তারাকে মূল মন্দিরের বাইরে বিশ্রামখানায় এনে পুজো করা হয় সারাদিন। তারপর সন্ধ্যারতির পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে। এদিন ভক্তরা মাকে স্পর্শ করে পুজো করতে পারবেন। কথাগুলো বলেই তিনি হাটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। দূর থেকে ভেসে এল তার চর্চিত গলায় গান, “মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…” 


আজ এমন একটা রাত, যে রাতে সার্থ হয় তারাপীঠে আসা। সাধারণ ভক্ত থেকে সাদু-সন্ন্যাসী-তান্ত্রিকদের। এ এমন এক রাত যে রাতে সব পথ মিশে যায় তারাপীঠ মন্দিরে, মহাশ্মশানে। তারাপীঠে পৌছে কথা হল মন্দির কমিটির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অনেক কথাই জানা গেল তার কাছ থেকে। আজ মায়ের দিনভর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই। ভোরেই মাকে মন্দির থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বিশেষ বিরাম মঞ্চে। তাকে পরিধান করানো হয়েছে রাজবেশ। হয়েছে মঙ্গল আরতি। আজ তার পুজো করবেন মন্দিরের সেবাইতরা। আর সেজন্য তাদের পালন করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম-নীতি। যেমন, আজ তারা উপবাসে থাকবেন সারা দিন।

 তারাময়বাবু জানান, বছরের এই একটি দিন মায়ের কোনও ভোগ হয় না। তাই সেবাইতরাও উপবাস করবেন। রাতে মায়ের কাছে ভোগ নিবেদন করার পর সেবাইতরাও ফলাহার করতে পারবেন। বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে এসেছিলেন শ্রীমতি বেলা মন্ডল, সঙ্গে তার স্বামী নিতাই মন্ডল। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, রোগ দেখাতে ভারতে এসেছিলাম। আমার বোনপো কলকাতায় থাকে। বলল, তোমরা এই সুযোগে তারাপীঠ ঘুরে এসো। আর এই দিন পাবে না। তাই চলে এলেম। কতো কিছু শুনেছি তারামা, সাধক বামাদেবের ব্যাপারে। আজ চাক্ষুস করবো মায়ের রূপ।"
 “মাকে কী বলবেন?” প্রশ্ন করেছিলেম। 
স্বামীর দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন, ওকে যেন মা ভালো করে দেন। আর আমার নাতিটা চলতে পারে না। বয়স ৮ বছর। বড় কষ্ট। ওকে যেন মা কৃপা করেন। 


 মায়ের এখানে এসে মায়ের অনেক রূপ দেখছি। কতো তান্ত্রিক। হয়ত, এদের মধ্যে অসাধুও আছে। আছে এমন সব মানুষ জন যারা অন্যের খারাপ করার বাসনায় হাজির হন তারাপীঠে। সবাই আছে, ভাল-খারাপ। আর সব মিলিয়ে মায়ের সেই শাশ্বত রূপ। বলতে ইচ্ছে করে আমারো… “কালো মেয়ের পায়ের নীচে দেখে যা রে আলোর নাচন…”



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad