ধর্মক্ষেত্রঃ শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবাজী; 'যেমন দেখেছি তাঁরে' ২

শ্রীবাবাজী মহারাজ হলেন মানুষ গড়ার সবচেয়ে বড় কারিগর, তিনি ছিলেন এই সমাজের শিক্ষক 

 “অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে

 অনেক অর্ঘ্য আনি; 

আমি অভাগা এনেছি বহিয়া নয়নজলে

 ব্যর্থ সাধনখানি।“

 কবিগুরুর ‘সাধনা’ কবিতার এই অংশটুকু দিয়েই আজ শুরু করা যাক। আমি এমন একজন মহামানবকে নিয়ে এই আলোচনা করছি, যিনি ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষক। জীবনে চলার পথের শিক্ষক। কেন শিক্ষক বলছি জানেন? একসময় যখন জানতে পারলাম শ্রীবাবাজী মহারাজ শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেও সন্ন্যাস জীবনকেই বেছে নিয়েছেন, নিজের ভালো’র কথা না ভেবে অন্যের মঙ্গল সাধনায় ব্রতী হয়েছেন, তখন অনেকটাই আশ্চর্য হয়েছিলাম। একজন মানুষ এম এ, ফার্স্ট ক্লাস, গোল্ড-মেডালিস্ট এবং ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে অনায়াসে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারতেন। কিন্তু, তিনি ব্যাক্তি-স্বার্থের জন্য সেই শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন নি। আশ্চর্য হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, তিনি শিক্ষকতা করলে ছাত্রসমাজ কতটা উপকৃত হতেন। কিন্তু, পরে আমার ভুল ভাঙলো। একটু ভাবতেই বুঝে গেলাম, তিনি শিক্ষকই। শুধু সামান্য ছাত্রদের নন, এই সমাজের সমস্ত মানুষের শিক্ষক। তাদের সঠিক পথ দেখানোর শিক্ষক, তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার শিক্ষক, তাদের সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষক। তিনি মানুষ গড়ার সবচেয়ে বড় কারিগর। তাকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে যাই সেখানে, কাল যেখানে শেষ করেছিলাম।

আজ দ্বিতীয় কিস্তি

তারক ঘোষ


 আমার শ্বশুরবাড়ির অনেকে এবং ওই গ্রামের বহু মানুষ, এমনকি তাদের গোটা পরিবারটাই তখন শ্রীশ্রী জানকীদাস মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছেন। আমার শ্বশুর-শাশুড়ী, খুড়তুতো শাশুড়ী, পাশের বাড়ির রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও তার পরিবার, পাড়ার নিতাই পালদের বাড়ি সহ অনেকেই শ্রীদাদাজী মহারাজের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছিলেন। 

শ্রীশ্রী স্বামী জানকীদাসজীর সঙ্গে শ্রীবাবাজী

শুনেছিলাম, শ্রীদাদাজী মহারাজ মাঝে মাঝে আসতেন রবীন্দ্রনাথবাবুর বাড়ি কিংবা পালেদের বাড়ি। বহু মানুষের সমাগম হত। আমি নিজে তাকে দেখিনি। কিন্তু শ্রীদাদাজী মহারাজের চলে যাওয়ার পর, একদিন এক সাধু আসেন ওই রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বাড়ি। আমি সেদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলে গেলেন, রবিবাবুর বাড়িতে ওনার সঙ্গে দেখা করে আসছেন। স্ত্রী ফিরে এসে আমাকে বললেন, শ্রীজানকীদাসজীর এক শিষ্য এসেছেন, উনি আজ দুর্গা দালানে পাঠ করবেন। আমি তখন সাংবাদিকতা করি। ওইটুকুই শুনলাম। 


গুরুত্ব দিই নি, কারণ, সাধু-সন্ন্যাসী নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। সাংবাদিকতা করার সময় একশ্রেণির ‘সাধু’ দের কীর্তিকলাপ দেখে আমি খুব বিরক্ত। সন্ধ্যায় আমার স্ত্রী চলে গেলেন, ওই নবাগত সাধুজীর পাঠ শুনতে। আমি শুধু বলে দিলাম, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাকে যেন রাতের খাবারটা দিয়ে যায়। বাড়িতে শুধু আমার ছোট্ট মেয়ে। সেও চলে গেল মায়ের সঙ্গে। একা বিছানায় শুয়ে বই পড়ছি। জানালার পাশ দিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে একদল মানুষ গেলেন। বুঝলাম ওই সাধুজীও গেলেন দুর্গা দালানের দিকে। 
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, আমার শ্বশুরবাড়ির দুর্গাপুজো খুব প্রাচীন, তখনই প্রায় ১৩৬ বছর পার করেছিল। যাইহোক, বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে গেছে, আমার স্ত্রীও সেই যে গেছেন, আর ফেরেন নি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তখনো ফিরলো না দেখে মনে মনে ভীষণ রেগে গেলাম। ভাবলাম, আজ একটা ঝগড়া হবেই, কোথাকার এক সাধুকে দেখার জন্য স্বামীকে অবহেলা! পাঠকগণ, মার্জনা করবেন, সেদিন যে ভাবনাটা এসেছিল, সেটাই লিখলাম।
যাইহোক, স্ত্রী ফিরলে, আমি তো তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় তিরস্কার করলাম। আমার স্ত্রী শুধু বললেন, ওনার পরিচয় জানলে তুমি নিজেও তার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে। আমি রেগেই বললাম, “সাধুর আর কী নতুন পরিচয়? ওরা তো মানুষকে ধর্মকথা শুনিয়ে দিগভ্রান্ত করার জন্যই আসেন, সেই সাধু কি আছে, যারা মানুষের জীবনটাকেই বদলে দিতে পারেন?” 
আমার স্ত্রী শুধু বললেন, উনি ডক্টরেট। 
 থমকে গেলাম। ডক্টরেট? মানে? 
উনি বললেন, এম এ ফার্স্ট ক্লাস।
আমি বললাম, মানে? 
যতই শুনছি, মনে মনে ততই দমে যাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে পুষে রাখা রাগটা যেন তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। আমার স্ত্রী বললেন, গোল্ড মেডালিস্ট। আমি চুপ করে কিচ্ছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললাম, উনি সাধু, মানে সন্ন্যাসী? 
স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ। 
আমি বললাম, কেন? 
পাঠকগণ, এই ‘কেন’ এর উত্তর খুঁজতেই আমি একদিন হাজির হয়েছিলাম তার তপোবনে। কিন্তূ, সেটা আরো পরের ঘটনা। শ্রীবাবাজী মহারাজ বলতেন, গুরু হাজার হাজার মিলবে, কিন্তু প্রকৃত শিষ্য মেলাই কঠিন। 
পরবর্তীকালে তার বলা আর একটা কথা আজো আমার কানে বাজে। তিনি বলতেন, গুরুকে যাচাই করে নে। অনেক ভেজাল গুরুও আছে জগতে। গুরু যেমন শিষ্যকে যাচাই করে নেবে, তেমনই শিষ্যেরও উচিত গুরুকে যাচাই করে নেওয়া। 

সেদিন আমার স্ত্রী আমার হাতে একটা কার্ড আর সেই সাধুর একটা ছবি তুলে দিয়েছিলেন। সেই ছবির জটাধারী মুখমন্ডলে শুধু চোখে পড়েছিল কী বিরাট এক প্রজ্ঞার দীপ্তি, কী অসম্ভব শান্ত মুখমন্ডল, কী অসামান্য রূপ। সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম ওই সাধুর নাম প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া। নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসী, শ্রীজানকীদাসজীর শিষ্য। সত্যি বলছি পাঠকগণ, সেদিন রাতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। 

আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad