শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ১৮

দিনের শেষে আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখা খুব দরকার 

তারক ঘোষ

পর্ব ১৮


 কাজকম্ম না থাকলে একশ্রেণির মানুষ, সে মহিলাই হোক বা পুরুষ হোক – দুটি কাজ করে। একটা হলো পরচর্চা আর অন্যটি হলো পরের দোষ খোঁজা। বাবাজী মহারাজ ‘ পরের দোষ’ দেখা বিষয়টি খুব অপছন্দ করতেন। পাঠের সময় বা অন্য ভক্তদের সঙ্সগে কথা বলার সময় প্রায়ই এই কথাটা তাকে বলতে শুনেছি। আমাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের কাজই হলো পরের দোষ দেখা। এদের হাত থেকে ভাষাও মুক্তি পায় না। ভাষাকেও ঘৃণার শিকার হতে হয়। এই শ্রেণির মানুষেরা ভুলে যান, ভাষা ভাবের বাহক। যে কোনো ভাষাই সমাদরের। 


ভাষা অন্যায় করে না। অন্যায় করে মানুষ। অশালীন ভাষা প্রয়োগ যে কোনো সভ্য সমাজে নিন্দনীয়। কিন্তু, যুক্তিপূর্ণ, শালীন ভাষা প্রয়োগকে সব মানুষই সমাদর করবে। কেউ যদি, ভিন্ন ভাষায় শালীনতার সঙ্গে তার অন্তরের ভাবনাকে প্রকাশ করে, তাতে কেউ দোষ দেখেনা। তবে এই সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, তারা দেখেন। এদের কথাই বাবাজী বলেছেন – পরের দোষ খোঁজা প্রসঙ্গে। 

ই মুহুর্তে কোনো এক বনেদি বাড়ির কথা মনে পড়ছে। দুর্গাপুজোর সময় ওই বাড়িতে বাংলা গান বাজানোটাই ছিল রেওয়াজ। কিন্তু, সময় বদলায়। প্রজন্ম বদলায়। তাই, এই প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বাংলার সঙ্গে বেশ ভালো অর্থবহ হিন্দি গান বাজানোর জন্য মাইকওলাকে বলে। ওদের কথায়, মাইকওলা হিন্দি গান চালায়।
 ব্যাস, একটু পরেই রে রে করে তেড়ে এলেন এক কর্তা। চিৎকার করে মাইকওলাকে ধমকাতে থাকলেন। হিন্দি গান কে বাজাতে বলেছে। নরাধম! 
মাইকওলা তো ভয়ে কাঁপছে। সে এ জীবনে দেখেনি, হিন্দি গান বাজালে, এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। ওই কর্তা তখন রেগে মেগে তাকে বাংলা গান চালাতে বললেন। 
ছেলে-মেয়েরা দূর থেকে দেখছিল কান্ডকারখানা। 
শুনতে পেলাম – মাইকে বাজছে… ‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি…” আর তারপর … ‘চন্দন-পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে…” 
ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করতে করতে চলে গেল। 
পরে জেনেছিলাম, ওই কর্তার মোবাইলে শুধু চটুল হিন্দি ও ভোজপুরী গানই নেই, এমন কিছু আছে, যা দেখলে অনেকেই ভিরমি খাবে। 
আসল ব্যাপারটা কী জানেন, আমরা এভাবে নিজের ঠকাই, অন্যদেরও। নিজের স্বরূপটা ঢেকে রেখে একটা ‘মিথ্যার চাদর’ দিয়ে নিজেদের ঢেকে রাখি। আমার নিজের চরিত্র অনুসারে বিচার করি অন্যদের। ভাষা কারো শত্রু হতে পারে না আর যদি হয়, সেটা হলো হয় সে এই দেশের সংবিধান স্বীকৃত অন্য ভাষাকে সম্মান করতে জানে না, কিংবা সে ভাষাশত্রু। 
এই শ্রেণির মানুষদের বুঝতে হবে, ভাষা যাই হোক না কেন, সঠিক জায়গায় শালীন ভাষায় কোন কিছু বলা হচ্ছে কি না। 


বাবাজী দুটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিতেন। একটি হলো আত্মবিশ্লেষণ, অন্যটি হলো অন্যের দোষ না দেখার অভ্যাস। তিনি বারবার বলতেন – দিনের শেষে বিছানায় শুয়ে ভেবে দেখবি, সারাদিন যে কাজগুলি করলি। সেই কাজগুলি যদি বিশ্লেষণ করে দেখিস কোনটি ঈশ্বর-সেবামূলক আর কোনটি নিছক অন্যের দুঃখের কারণ সৃষ্টিকারক।
 তিনি পরনিন্দা-পরচর্চা একদম পছন্দ করতেন না। 
বলতেন, মানুষের কাজ না থাকলেই এসব করে। তাই ঈশ্বরের দিকে মন রেখে গৃহী মানুষকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে জোর দিতে বলতেন। 


যাইহোক যা বলছিলাম। আমরা যে বছর দীক্ষা নিই অর্থাৎ ২০০৩ সাল। সে বছর ডিসেম্বর কিংবা ২০০৪ এর জানুয়ারীতে গীতাযজ্ঞ দেখার অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। গীতাযজ্ঞ কী, কেন করা হয় – সে ব্যাপারে কোনো জ্ঞান ছিল না। 
যাইহোক, গীতাযজ্ঞের আগের দিন বিকালেই পৌছে গিয়েছিলাম আশ্রমে। সেবার শুধ আমরাই যাইনি, আমাদের স্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ১০-১২ জন আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। এদের অনেকে ছিলেন দাদাজী মহারাজের শিষ্য-শিষ্যা, অনেকে গিয়েছিলেন বাবাজীর কাছে মন্ত্র-দীক্ষা নেওয়ার জন্য। বাবাজীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বাবাজী সেদিন ভীষণ ব্যস্ত। রাধামাধবের উপর দায়িত্ব।
 কিন্তু, আশ্রমে সেদিন তিল ধারণের ঠাই নেই। একে প্রবল শীত, তার উপর হাজার হাজার ভক্ত। কোনরকমে রাধামাধব একটা আশ্রয় ঠিক করে দিলেন। 

সে এক অপূর্ব ক্ষণ, জীবনে ভুলবো না। কতো মানুষ! কেউ এসেছেন এই বাংলার নানা প্রান্ত থেকে, কেউ এসেছেন আসাম থেকে, বৃন্দাবন থেকে এসেছেন বহু সাধু-সন্ন্যাসী। এ যেন এক মিলনমেলা। গৃহী আর সাধু সন্ন্যাসীর এই মিলন মেলায় এক অলৌকিক খোঁজ। কী সেই খোজ? ঈশ্বরের? শান্তির? নাকি, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় এত মানুষ। 
এর আগে, সাংবাদিকতার সূত্রে প্রয়াগ কুম্ভে গেছি, সাগরমেলা কভার করেছি, গিয়েছি, জয়দেবের মেলায়। কিন্তু, এ যেন, এক অন্য সঙ্গম। এখানে একটাই মুখ, এক জ্ঞানী তপস্বীর। আর তার জন্য, এত মানুষের কোলাহল। 
রেললাইনের ধারে দাদাজী মহারাজের সমাধি মন্দিরের পাশের মাঠ সেদিন পরিপূর্ণ। কানায় কানায়। শীতের কুশা মাখা সকাল। ঝিরঝিরে কুয়াশায় ঢাকা চরাচর। কুয়াশা ভেদ করে মানুষের আবছায়া মূর্তির চলাফেরা। ১৮ টা কুন্ড কাটা হয়েছে যজ্ঞের জন্য। 
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad