শ্রীশ্রী ১০৮ স্বামী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াঃ যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ২১


তিনি বসে আছেন নৌকার হালে, ভক্তদের কাজ দাঁড় টেনে যাওয়া, নৌকো লক্ষ্যে পৌঁছাবেই 


তারক ঘোষ


পর্ব ২১

 বাবাজী যদি কোনো নৌকার হালে বসে থাকেন, তাহলে ভয় কীসের? আমাদের কাজ কর্ম করে যাওয়া। দাঁড় বাওয়া। উনি আমাদের প্রত্যেককে তীরে পৌছে দেবেনই। কিন্তু, আমরা যদি কর্ম না করে, শুধু ওনার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি? তাহলে, আমরা ডুববো না, কিন্তু তীরে পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। কাঠিয়াবাবার নৌকায় যিনি উঠেছেন, তিনি ধনী-নির্ধন, যাইই হন না কেন, লক্ষ্যে পৌঁছাবেনই। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই, থাকতে পারেও না। 
আমি যে মহামানবের কথা লিখছি, সেটা তার জীবনী নয়, তার কাজের বিশ্লেষণ নয়। সে ধৃষ্টতা আমার নেই। আমার চোখে তিনি যেভাবে ধরা দিয়েছেন, এমনকি দেহান্তের পরও তিনি কীভাবে আমাদের সকলকে রক্ষা করে চলেছেন, সেই কথাই বলতে বসেছি। তবে, বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হলে মন্ত্র জপ করতেই হবে, নইলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর ডাকতে হবে, জলে ডুবে মরতে বসা মানুষের মতো, নইলে হবে না। 
 আমি অনেকবার সময়ের অভাব দেখিয়ে জপ করা বন্ধ রেখেছিলাম। ব্যস, কোনো কাজেই আর সফলতা আসছে না, বাড়িতে তর্কাতর্কি, অযথা মনের মধ্যে নানা অসন্তোষ। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত হয়ে উঠছিল ভয়ঙ্কর। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম, ভুল কোথায়। আমার স্ত্রী বললেন, জপ করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই হল। আমাদের সব কিছু করার সময় মিলে যায়, কিন্তু জপের সময়, আমরা যদি অযথা কর্মের বাহানা তুলি, বাবাতো ধরে ফেলবেনই। 


আর একটা কথা। তিনি শিষ্যকে দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করে নেন। দুঃখ সইতে সইতে যদি আপনার মনে সন্দেহ আসে, কেন দীক্ষা নিলাম! তাহলে, নিজের কর্মের দিকে তাকান। তিনি যে মুহুর্তে আপনাকে তার আশ্রয়ে এনেছেন, সেই মুহুর্ত থেকে আপনার সমস্ত দায় তার। কিন্তু কর্ম আপনার। যেটুকু খাদ, তখনো আপনার মধ্যে লুকিয়ে আছে, সেটুকুকেও উনি পুড়িয়ে খাঁটি করে নেবেন। এ ব্যাপারে আমার আর কোনো শঙ্কা নেই। 
আমি আজও তার আশির্বাদে রয়েছি, তা যদি না হতো, আমি লেখার অবস্থায় থাকতাম না। তার ইচ্ছা না থাকলে, আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কিচ্ছু না। আমি তার প্রমান পেয়েছি। আর এখনো পাচ্ছি। তিনি যে কতরূপে আপনার কাছে আসবেন, আপনি জানতেও পারবেন না। শুধু মনে রাখবেন, পরীক্ষায় উনি আপনাকে সফল দেখতে চান, আমাদের বায়োলজিক্যাল পিতা-মাতার মতোই। ভাববেন না, আমি আপনাদের কোনোরকম জ্ঞান দিচ্ছি, সে ক্ষমতা একমাত্র ওনার আছে। শুধু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা আর আমার চোখে আমি ওনাকে কীভাবে দেখেছি, সে টুকুই আপনাদের কাছে নিবেদন করছিমাত্র। বিশ্বাস করুন, আজও এই লেখা যখন লিখি, উনি আমার সঙ্গে থাকেন, নইলে, আমি লিখতে পারতাম না। 
একদিন আশ্রমের পুরানো মন্দিরে বসে আছি। রাত তখন ১১ টা হবে বোধহয়। যেখানে অতিথি ভবন, তার কাছেই একটা তক্তপোষ ছিল, সেখানে বসে আছি। ইচ্ছা ছিল, নতুন একটা বই নিয়ে আলোচনা করবো। একটা অসাধারণ প্লট মাথায় খেলছিল। চাইছিলাম বাবার কাছে জানাতে। তিনি এলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। 
আমি কিছু বলার আগেই, উনি বলে উঠলেন, আসামের কিছু মানুষদের নিয়ে লেখ না। দরকার হলে আমাকে বলিস, কোথায় যেতে চাস, আমি যাবো তোর সঙ্গে।
 বাবার সঙ্গে আমার কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, বাবা আমার লেখা বইকে নিয়ে গেছেন আমেরিকা, গ্রীনল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, মিশর,অষ্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানী সহ পৃথিবীর ৭৮ টি দেশে, সেখানে আমি পা রাখিনি, কিন্তু আমার বই পাওয়া যায়। 
তিনি আছেন আমার লেখার সঙ্গে। সেদিন রাতে বাবাকে আমার লেখার বিষয়টা বলেছিলাম। উনি বলেছিলেন, লেখ না। কিন্তু সেই লেখাটা অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। আমার এখনো সেই লেখা হয়ে ওঠে নি। 


 আমার মনে হয়, বাবাজী মহারাজ দীর্ঘ সময় ধরে বেদ-বেদান্ত-দর্শন,উপনিষদ পাঠ করে যা কিছু পেয়েছিলেন, সব কিছু অকাতরে দান করে গেছেন, আমাদের মধ্যে, আমরা তা নিতে পারি নি। আমরা এমন মানুষ, দিতেও শিখিনি, ঠিকভাবে নিতেও শিখিনি। তার সব কথা যদি নিতে পারতাম, তাহলে নিজের দুঃখের কথা কাউকে বলতে হতো না, কেননা, দুঃখই থাকত না। 
বাবাজী মহারাজ শঙ্করদেবের দর্শন সম্বন্ধে লিখছেন – “শুদ্ধচরিত্র ব্যক্তিগণকেই বৈষ্ণব বলা যেতে পারে। প্রকৃত বৈষ্ণবের কোন জাতি নাই, শত্রু নাই, তিনি মানবতার পূজারী। এই অর্থে প্রত্যেক সৎ ব্যক্তিই বৈষ্ণব। ভগবানের ভক্ত বা সত্য শিব সুন্দরের পূজারী ব্রাম্ভন নন, ক্ষত্রিয় নন, শূদ্র নন, বৈষ্ণব নন, মুসলমান নন, খ্রীষ্টান নন, তিনি ভক্ত। পৃথিবীটাকে সুন্দর করার জন্যই তারা জীবন ধারণ করেন।“

 এই কথাগুলো নতুন করে তুলে আনলাম কেন জানেন? কারণ, বাবাজী মহারাজ যা লিখতেন, তা বিশ্বাস করতেন, আর তা নিজের জীবনে পালন করতেন। 


একবার সন্ধ্যায় বাবাজীর কাছে বসে আছি। দেখলাম ওই গ্রামের এক বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। বিশেষ কারণে, আমি তার নাম লিখছি না। তার মেয়ের খুব অসুখ। বাবাকে তিনি যেইমাত্র সেকথা নিবেদন করলেন, বাবাজী রেগে গিয়ে বললেন, "তোকে কতবার বলবো, ডাক্তার দেখা, দক্ষিণভারতে নিয়ে যা। তুই কোন কথাই শুনছিস না। মেয়েটাকে যদি এভাবে রেখে দিস, ও মরে যাবে যে! যা, দরকার হয়, এখানকার সবাই তোকে সাহায্য করবে। তুই এখনি ওকে নিয়ে যা। আর আমি ভগবানের কাছে নিবেদন করব।" 


তারপর দেখলাম, উনি কাউকে বললেন কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বাবা বিশ্বাস করতেন – জগত সত্য, ঈশ্বরও সত্য। তাই জাগতিক কাজকর্মকে তিনি যেমন গুরুত্ব দিতেন, তেমনই বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা তার মধ্যে সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকত। মেয়েটি এখন সুস্থ। বাবাজীর দেহান্তের পর তার বাড়িতে আমি আর আমার স্ত্রী গিয়েছিলাম। ভালোই আছে। 
বাবাজী জানতেন, কখন, কোথায়, কী করা উচিত। সেই শিক্ষাই বারবার আমাদের তিনি দিয়ে গেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। 
একবার এক বৃদ্ধা এসে বাবাকে প্রণাম করে বসলেন, বাবার সামনের লাল মেঝেতে। তারপর আঁচলের গিঁট খোলার চেষ্টা করলেন। তাকিয়ে দেখলাম, বহু কষ্টে সেই গিঁট খুললেন, কেননা তিনি এতো বেশি গিঁট দিয়েছিলেন যে, খোলা বেশ কঠিন। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কী এমন অমূল্য বস্তু ওখানে আছে, সেটা দেখার জন্য। 
দেখলাম, উনি গিঁট খুলে বহুবার ভাঁজ করা একটা ১০০ টাকার নোট বের করলেন। তারপর, বাবার পায়ের কাছে গিয়ে সযত্নে ওই টাকাটার ভাঁজ খুলে রাখলেন। বাবা দেখলাম, খুব রেগে গেছেন। বললেন, এসব কেন এনেছেন? উনি বললেন, বাবা, এটা তোমাকে নিতেই হবে। নাহলে, আমি শান্তি পাব না। বাবা আর কিছু বললেন না। 
ওই বৃদ্ধা চলে যাওয়ার পর একজনকে ডেকে বললেন, "ওই টাকাটা ওকে ফেরত দিস, বহু কষ্ট করে এনেছে, চুরি যাওয়ার ভয়ে কীভাবে গিঁট দিয়ে রেখেছিল। উনি যেন কষ্ট না পান, এমনভাবে টাকাটা ওকে দিয়ে দিস। "
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad