গীতাযজ্ঞে, যেমন দেখেছি তাঁরে..পর্ব ১৯

মনে হয়েছিল, আমরা শিষ্য হয়েছি ঠিকই, কিন্তু গুরুদেবের কাছ থেকে পাওয়া কোন শিক্ষাই পালন করি না।

তারক ঘোষ

পর্ব ১৯

কাহে কো দুখ পানা, কাহেকো মরনা - - হাম তো কহতে হ্যায় ভগবত কা প্রসাদ লো, ইসসে তো কুছ দোষ নহী। দুখমে মিলয়া নহী
 শ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়াজী

 শুনলাম, শ্রীশ্রী রামদাসজী কাঠিয়াবাবার তিরোধান তিথিকে কেন্দ্র করেই আয়োজন করা হয় গীতাযজ্ঞের। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলি। ললিত কুমার বসু তার সংকলনে লিখেছেন –“ শ্রীশ্রী কাঠিয়াবাব্জী বাং ১৩১৬ সালের ৯ ই মাঘ ভোররাত্রে মানবলীলা সম্বরণ করেন। ব্রম্ভাজ্ঞ মহাপুরুষের মৃত্যু তাহাদের ইচ্ছাধীন। তাহার দেহত্যাগও যে অনুরূপভাবে হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।


 ৮ তারিখ মধ্যরাত্রে এই মহাপুরুষ তার পরিচারক রামফলকে ডেকে তার কাছ থেকে জল চেয়ে পান করলেন। তারপর বললেন, ‘রামফল, তেরে হাথ কা জল ভী পী লিয়া, অব তু সোয় জা, মৈ ভী অব জাউঙ্গা।‘ তার কয়েক ঘন্টা পরেই তিনি দেহত্যাগ করেন।“ 


বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। আমার মেয়ে তখন খুব ছোট। বছর ৫ বয়স বোধহয়। ওকে নিয়ে রেললাইনের পাশে দাদাজী মহারাজের সমাধি মন্দিরের কাছের রাস্তার পাশে দাড়িয়েছিলাম। একজন চা বিক্রি করছিল। ওকে ডেকে চা নিলাম। 
মেয়ের জন্য একটা, আমার একটা। কিন্তু একটাতে ঠান্ডা গেল না। ওকে দাঁড় করিয়ে পর পর ৫ কাপ চা খেলাম, মাটির ভাঁড়ে। চা খেয়ে দেখলাম, শীতটা আর তত বোধ হচ্ছে না। ওদিকে একের পর এক কুন্ডে শুরু হয়েছে যজ্ঞ। অন্যদিকে বিশাল কড়াইতে তৈরি হচ্ছে প্রসাদ। 
আকাশে বাতাসে কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে হোমের স্বর্গীয় গন্ধ। অবাক হয়ে দেখছি। মানুষের বিশ্বাস, মানুষের ধর্ম, মানুষের মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন সংষ্কৃতি। 
এটা কি আধুনিক সমাজ, না কি সেই প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা। সংষ্কৃত মন্ত্র যেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই যুগে। কিছুক্ষণ আনমনা হয়েছিলেম। মেয়েটা কখন হাঁটতে হাঁটতে অন্যদিকে চলে গেছে খেয়াল ছিল না। আচমকাই খেয়েল হলো, ওপাশে রেললাইন। ছুটে গিয়ে ওকে ধরে ফেললাম। 


বাবাজীর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, উনি পুজোয় বসেছেন। এদিকে ভীড় ক্রমশঃ বাড়ছে। আসপাশের গ্রাম থেকে হাজার ঝাজার মানুষ আসছেন। যজ্ঞ দেখতে, বাবার আশীর্বাদ নিতে আর প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য। সত্যি বলছি, পরবর্তীকালেও গীতাযজ্ঞে গেছি, কিন্তু সেদিনের গীতাযজ্ঞ আমার মনে যে ছাপ রেখে গিয়েছিল, সেই টা আর খুঁজে পাইনি। কেন? 
আসলে বাবাজীর উপস্থিতি সমগ্র পরিবেশকে বদলে দিয়েছিল। আমার স্ত্রী তখন বাবাকে খুজছেন। ওনার ইচ্ছে বাবার বুকে তুলসী পাতা দেওয়ার। এদিকে সকালে খেয়ে ফেলেছেন। মনের মধ্যে, সেইটা বার বার ঘুরছে। এই দোটানা নিয়ে ঘুরছেন। ওর বাপের বাড়ির গ্রাম থেকে আসা এক মহিলা ওকে বলছেন – এক পেট খেয়ে বুকে তুলসী পাতা দেওয়া যাবে না। আমার স্ত্রী ভেঙ্গে পড়লেন। উনি না জেনেই খেয়ে ফেলেছেন। শেষে বললেন, আমি বাবাকেই জিজ্ঞাসা করবো। 
কিছুক্ষণ পরে উনি হাসিমুখে এসে বললেন, বাবার বুকে তুলসী পাতা দিয়েছি, বাবা নিয়েছেন, আর কী হয়েছে জানো?” বললাম, “কী?” যে আমাকে বলে গেল, একপেট খেয়ে তুলসী পাতা দেওয়া যাবে না, উনি তুলসী পাতা দিতে পারেননি। বাবা তার আগেই উঠে পড়েছেন। 


সত্যি বলছি পাঠকগণ, আমার স্ত্রী না জেনেই সেদিন খেয়েছিলেন, কিন্তু ওনার ইচ্ছে হয়েছিল, বাবার বুকে তুলসী পাতা দিয়ে প্রণাম জানানোর। বাবা সেদিন মানুষের অন্তরটাই দেখেছিলেন, তার বাহ্যিক টা দেখেননি। 
শ্রীসন্তদাসজী কাঠিয়া মহারাজ লিখছেন – আশ্রমকে যাতে শিষ্যরা ভোগবিলাসের স্থান করে না ফেলেন, এটাই তার মনের একান্ত ইচ্ছা ছিল। আবস্তবিক, এখন অধিকাংশ দেবালয় ও সাধুদের স্থান অনেক জায়গায় সাংসারিক লোকের চেয়েও অধিক পরিমাণে ভোগবিলাসের আবাসভূমি হয়ে পড়েছে; ভজন সাধনের দিকে দৃষ্টি অতি অল্পস্থানেই আছে। কোন কোন স্থানে অল্প পরিমাণে শাস্ত্রের চর্চা আছে সত্য, কিন্তু অভ্যন্তরীক শুদ্ধি ও ভগবন্নিষ্টার দিকে বিশেষ লক্ষ্য অতি অল্প স্থানেই দেখতে পাওয়া যায়।“
 শ্রী সন্তদাসজী লিখছেন – “বাবাজী মহারাজ তার নিজের আশ্রমটি যাতে এরকম অবস্থা প্রাপ্ত না হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। তার আশ্রমের সাধুদের প্রতি তার ব্যবহার এই নিয়মের অধীন ছিল বলে আমি বুঝেছিলাম। তিনি নিজে অনেক সময়ে রাত্রে ভোরের সময় আহার করতেন। 
সেই সময় তার ক্ষুধা পেয়েছে, এরকম ভান করে , মধ্যরাত্রে সকলকে জাগাতেন। বাধ্য হয়ে, সেই সময় সকলকে জেগে উঠতে হতো এবং স্নানাদি করে কেউ রসুই কাজে, কেউ ঠাকুর সেবায়, কেউ অন্য কাজে লেগে পড়তেন। অনেক সময় রাত্রে চোর আসবে ভয় দেখিয়ে শ্রীযুক্ত বাবাজী মহারাজ সবাইকে মধ্য রাত্রে জাগিয়ে সেবার কাজে নিযুক্ত করতেন।“ 


আমি বাবাজির মধ্যে দেখেছি এই আশ্রমিক নিয়মনিষ্ঠা। বাবার কাছে আশ্রমে আগত ভক্তরা ছিলেন নারায়ণের রূপ। তাদের কেউ আশ্রম থেকে কোনো দিন অভূক্ত অবস্থায় প্রসাদ পেয়ে ফিরে জাননি। কিন্তু, আমার দুর্ভাগ্য, মাত্র কয়েক বছর আগে, আমার চোখের সামনে এক অন্য ঘটনা ঘটে। যা সেদিন আমাকে অনেক ভাবিয়েছিল। 
দেখতে পেয়েছিলাম, বাবাজীর সময়কাল আর বর্তমান সময়কাল, এই দুই এর মাঝে এক বিরাট ফাটল। অথচ বৈষ্ণবদের ধর্ম হলো মানহীনকে মান দেওয়া, ঘাসের চেয়েও সহিষ্ণুও হওয়া আর অতিথিকে নারায়ণ্রূপে সেবা করা। আমি সেদি বর্তমান মন্দিরের নীচে রসুইখানার সামনে একটা চেয়ারে বসেছিলাম। এক ব্যক্তি এলেন। এসে বলনেন, মুড়ি পাওয়া যাবে? আমার পরিবারের লোকজন আছে। এখানে কিছু চিনি না। আশ্রম দেখতে এসেছিলাম। 


ওই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি কি এই আশ্রমের শিষ্য। উনি অসম্মতি জানালেন। তখন তাকে বলা হলো, এখান থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। ওই ভদ্রলোক চলে গেলেন। সত্যি কি একটা মানুষ চলে গেলেন? না কি, মানুষবেশী স্বয়ং প্রভু সেদিন চলে গেলেন? 
এই ভাবনাটা এসেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল, আমরা শিষ্য হয়েছি ঠিকই, কিন্তু গুরুদেবের কাছ থেকে পাওয়া কোন শিক্ষাই পালন করি না।
আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad