অনুভূতিঃ ৩য় পর্ব





বিজ্ঞানের গতি স্তব্ধ হয় মৃত্যু-নদীর তীরে। তাই আমাদের বিজ্ঞান জানাতে পারে না, এরপর কী! গুরুদেবের দেহান্তের পর এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী তার কিছু ভক্ত, যা আপনাদের নতুন করে ভাবাবে। 




পার্থপ্রতীম সুর


 “তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভ’রে, 
তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে?”

 যাক, আমরা ভালোভাবেই যে যার বাড়ি ফিরলাম সেবার। দু-তিন মাস দেরি ছিল গুরুপূর্ণিমার। মাঝে পিসিও থেকে বাবার সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলেছিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আমার এক মাসী, যিনি আমার আশ্রমে যাওয়া বা মন্ত্র নেওয়া নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন, সেই তিনি আশ্রমে গিয়ে বাবার কাছ থেকে মন্ত্র নিলেন। আর গেলেন, আমার সঙ্গে গুরু পূর্ণিমার দিন। 
শ্রীবাবাজীর লীলার শুরু সে থেকেই। এরপর আমার জীবন এতটাই পালটে গেল যে কাউকে বললে, সে আমাকে হয় পাগল ভাববে, নয় আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি এমন কেউকেটা নই যে আমার জীবনী লিখতে বসেছি। 
আসলে বাবার কথা বলতে গেলেই আমার জীবনে তার লীলার প্রসঙ্গ বার বার এসে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন কবিগুরুর সেই ‘কৃপণ’ কবিতার মতো সবটুকু উজাড় করে দিতে পারিনি আর তিনি আমার জীবনকে ভরিয়ে তুলেছেন কল্পবৃক্ষ হয়ে। 

"পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি --একি!,
ভিক্ষা মাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি!"


২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের গুরুপূর্ণিমা পর্যন্ত বাবার সংস্পর্শে আসার ভাগ্য হয় আমার। ২০০৪ সালের গুরুপূর্ণিমার কয়েক মাস পরেই আমি বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা চলে যাই আশ্রমে। বাবাকে গিয়ে জানাই, “আমি সন্ন্যাস নেব।“ বাবা অন্তর্যামী, সবই জানেন। 
তবু বললেন, “তুই মা-বাবার একমাত্র সন্তান, মাকে কে দেখবে?” 
বললাম, “জানি না।“ 
তিনি বললেন, “আশ্রমে থাক, কাজটাজ কর।“ 
আমি আশ্রমে রয়ে গেলাম। আশ্রমের কাজটাজ করতে আরম্ভ করলাম। এদিকে, বাড়িতে তখন থানা-পুলিশ হওয়ার উপক্রম। পরে শুনেছিলাম, বাড়ি থেকে বাবাকে ফোন করে অনেক কুকথা শোনানো হয়েছে। কিন্তু, শ্রীবাবাজী সে-সব কথা আমাকে জানতেও দেন নি। 
একদিন প্রসাদ পাওয়ার পর তিনি আমায় ডাকলেন। দেখি, তিনি বজ্রাসনে বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে মেমারীর নুদীপুরের মিঠুদা। মিঠুদা, বাপ্পাদা, ধ্রুবদা, নাড়ুদা বাবার খুব প্রিয়পাত্র। আমি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। 
বাবা বললেন, “কিরে, কী করবি তুই?” 
বললাম, “আপনাকে তো বলেইছি।“
 বাবা বললেন, “আমি এখন তোকে সন্ন্যাস দিতে পারবো না, তবে দীক্ষা দিতে পারি। আগামি দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন চলে আসিস, দীক্ষা দেব।“ 
আমি গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু, বুঝতে পারিনি, সেই বাড়ি ফেরাই আমার কাল হলো। বুঝতে পারিনি, আরো বন্ধনে জড়িয়ে পড়বো আমি। 


ওনার কথামতো সপ্তমীর দিন এলাম আশ্রমে। শুনলাম বাবা পাটুলিতে। লালুর সাইকেল নিয়ে ছুটলাম পাটুলি। দেখলাম, বাবা একটা দুর্গামন্ডপে পাঠ করছেন। কী অপূর্ব বিশ্লেষণ। বাবা স্টেজে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে। পরণে সেই সাদা ধুতি, কাঁধে উত্তরীয়। সমস্ত শরীরে তিলক-স্বরূপ। গলায় গাদা ফুলের মালা পড়িয়েছেন গ্রামের মানুষ। বাবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তার কথা শুনছি। 
আচমকা কী যে হয়ে গেল আমার! দেখলাম, বাবা নয়, বাঘছাল পরিহিত স্বয়ং শিব কথা বলছেন, ব্যাখ্যা করছেন দুর্গাপুজো তত্ব। চোখ রগড়ালাম গভীর বিষ্ময়ে। 
ভুল দেখছি ভেবে যতবার চোখ রগড়ে তাকাচ্ছি, সেই একই দৃশ্য! না, কোনো পরিবর্তন নেই। বিশ্বাস করুন, এই কথা লিখতে লিখতে আজও আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। 
এ কথা আমি কাউকে কোনদিন বলিনি। সবকিছু, নিজের মধ্যেই রেখেছিলাম। আজ বলবো, অনেক কিছুই বলবো। বাবার আশির্বাদে আর তারক ঘোষ মহাশয়ের অনুরোধে আর প্রেরণায় আমার অনুভূতি লিখতে বসেছি। গীতায় হাত রেখে বলতে হয়নি – যারা বলিব সত্য বলিব…কারণ, শিষ্য অতি তুচ্ছ হলেও গুরু যে স্বয়ং সদগুরু। তার কাছে মিথ্যা বলার, অন্যায় করার, অসদ চিন্তা পর্যন্ত করার উপায় থাকে না। আমি হয়তো ভক্ত প্রহ্লাদের মতো তাকে ডাকতে পারিনি, নিজেকে সমর্পণ করতে পারিনি। কিন্তু, তিনি আমাকে ভক্ত প্রহ্লাদের মতোই কোলে বসিয়ে রেখেছেন। আমি বাবাকে স্মরণ করতে না পারলেও, তিনি আমার মতো এক তুচ্ছ কীটকেও ভোলেন নি বা ত্যাগ করেন নি। সর্বদা আমাকে আগলে রেখেছেন।


 ২০০৬ সাল থেকে শ্রীবাবাজীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১১ সালে কেন্দ্রিয় সরকারের চাকুরি নিয়ে দিল্লি আসি। ২০১৪ থেকে ২০১৯ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও কর্মরত ছিলাম। ২০১৩ সালে আমার বিবাহ হয়। আমার স্ত্রীকেও জানিয়েছিলাম আমার জীবনে বাবার ভূমিকা। সে ভয় না পেয়ে উলটে যেতে চাইলো আশ্রমে। 
কিন্তু, আমার মা এতটাই বাধা দিয়েছিলেন যে ও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো। আমার জপের মালাও গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিলেন। আর আমি খুব কষ্টে, দু;খে থাকতাম। আমি বাবার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। 
যে শরীরকে ওনার কাছে উৎসর্গ করেছি, ঠাকুরজীর সেবায় নিয়োজিত করতে চেয়েছি, সেই শরীরকে জড়িয়ে ফেলেছি সংসারের বন্ধনে। বাবার কাছে যাবার জন্য মন ব্যাকুল হলেও, লজ্জায় পারিনি যেতে। এরকম একদিন স্ত্রীকে বাবার ছবি দেখাবো বলে গুগল সার্চ করছি, আচমকাই আনন্দবাজারের একটা খবর। ২০১৪ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় শ্রীবাবাজীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। 
আমার সামনে দুলে উঠল সমস্ত পৃথিবী। ফোন করলাম মেমারীর বন্ধুদের। জানলাম সব সত্যি। তখন চোখের জল ছাড়া বাবাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছু নেই। ওনার শেষ ছবিটার দিকে যতবার তাকাই, উপলব্ধি করি ওনার কষ্ট। 


সকলকে যিনি এতো ভালোবাসেন, যাদের জীবনকে আধ্যাত্মিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য তিনি মর্ত্যধামে এসেছেন, তাদের ছেড়ে শরীর ত্যাগ করতে তিনি কতটাই না কষ্ট পেয়েছেন। আমার স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীবাবাজীর কাছে আর যাওয়া হয় নি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বামী বিষ্ণুদাসজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে দিল্লির স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে। ওনার চিকিৎসা চলছিল তখন। আগামিকাল

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad