No title


অনুভূতি 

 পার্থপ্রতীম সুর 


 বার ১৮ বছর একই নামে লিখতে বসলাম। ‘অনুভূতি’ থেকে ‘উপলব্ধি’ হতে পারতো। কিন্তু, না। আমি সেই অনুভূতির কথাই সকলকে বলতে চাই। সেই অনুভূতির কথা – যা পেলে পৃথিবীর সমস্ত ‘পাওয়া’ ছোট হয়ে যায়। আর সেই অনুভূতি, যার মাধ্যমে আসা সম্ভব – সেই মহামানব, সেই গুরুরূপী ঈশ্বর –তার সম্পর্কে অনেক কথাই বলতে চাই। তিনি আমাদের মধ্যে স্থুল শরীরে না থেকেও কীভাবে সর্বক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকেন ও কীভাবে আমাদের রক্ষা করেন, আমি আমার সামান্য উপলব্ধি দিয়ে আপনাদের বলতে চাই।

এই অধমের নাম পার্থপ্রতীম সুর। 
আমার নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং বালক ব্রম্ভচারী মহারাজ – বাবা-মার গুরুদেব। 
আমার জন্ম হুগলি জেলার চন্দনগরে, মানুষ হই মামার বাড়িতে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি গড়বাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। 
এরপর চন্দননগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে গণিতএ স্নাতক হই। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন মেমারীর দুই ছাত্র সৌরভ ও সুপ্রদীপ চুঁচুড়া-চন্দনগরে মেসে থাকতো। ওরা আমার বেশ ভালো বন্ধু ছিল। ওদের মেসে আমার যাতায়াত ছিল। 
সেই সূত্রেই ওদের মেসেই আমি প্রথম এই মহাপুরুষের ছবি দেখি। সেই ছবি দেখার পর আমি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়ি, সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
 সেটা ছিল ২০০৪ সাল। গরমের ছুটি পর্যন্ত যেন আর অপেক্ষা করতে পারছি না। 
কিন্তু, অপেক্ষা করতেই হবে। কেননা আমাদের গুরুদেব বলতেন ‘সঠিক সময়ের’ কথা। যেটা পাওয়ার, সময় হলেই তবেই সেটা পাওয়া যায়। আমরা চাইলেই তা পাবো না। সেটাতে ভবিষ্যতে ফল ভালো নাও হতে পারে। 
কেন এই কথা বলছি, সে ব্যাপারে কতকগুলো দৃষ্টান্ত আমি পরে দেব। যাক, কোনো একদিন সেই শুভ মুহুর্ত এলো। 
আমার বন্ধুরা জানালো, আমি ছবিতে যাকে দেখেছি, তার আশ্রমে অর্থাৎ নতুনগ্রামে যাওয়া হবে। আমি একরাত মেমারীতে ওদের সঙ্গে পরের দিন ভোরে বাসের ছাদে চড়েই পৌছে গেলাম কালনাতে। সেখান থেকে ট্রেনে পাটুলি। 


ট্রেন থেকে নেমে ভ্যান-রিকশায় (তখন যন্ত্রচালিত ভ্যান আসেনি) চেপে রেললাইন পার হয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম আশ্রমের সামনে। তারপর আমবাগানের মধ্যে দিয়ে আশ্রমে। প্রথম আলাপ রাধামাধবজীর সঙ্গে। ছোট্ট সাধু। ঘর খুলে দিয়ে আমাদের স্নান করে নিতে বললেন। আরতি হবে। তাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে চলে গেলাম মন্দিরের সামনে। গ্রামের অন্যান্য মানুষ ও ভক্তদের দেখলাম। কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজ, ধূনোর গন্ধে পরিবেশ একেবারে বদলে গেল।


 আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই মহাপুরুষের দর্শনের জন্য। মন্দিরের দরজা খুলে গেল। আরতি আরম্ভ হলো। হঠাৎ মন্দিরের পাশ থেকে একজনকে আসতে দেখলাম। এই আধুনিক যুগে এ কোন মহর্ষিকে আমি দেখছি! মাথায় জটা, কোমরে কাষ্ঠ-বন্ধনী। শান্ত মুখমন্ডল, ততোধিক প্রশান্তি চেহারায়। মন্দিরের দরজার একপাশে এসে দাঁড়ালেন।
 আরতি-স্তুতি খুব একটা বুঝতে পারছিলাম না। যদিও রাধামাধবজী সবাইকে একটা পুস্তিকা দিয়েছিলেন, যাতে স্তুতি ছাপা ছিল। আরতি শেষ। শুরু হলো মন্দির প্রদক্ষিণ। তারপর প্রদক্ষিণ শেষে শ্রীবাবাজী বসলেন তার ঘরের সামনে লাল বারান্দায়। 


সকলে প্রণাম করে সামনে বসলেন। আমিও সকলকে অনুসরণ করে চলেছি। আমার প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছে, ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। হঠাৎ চোখ পড়লো শ্রীবাবাজীর চেয়ারের পাশে একটা ছোট কাঠে লেখা – “দয়া করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন না।“ 
তাই আমি একবার ওনার দিকে, আর একবার লেখাটার দিকে, তারপর আবার তার পদযুগলের দিকে দেখছি। শেষে মনের ইচ্ছাটাকে দমন করতে না পেরে সুপ্রদীপকে বললাম আমার সেই সুপ্ত ইচ্ছার কথা। ও সব শুনে, উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীবাবাজীর কাছে গিয়ে বলল, “বাবা, এর নাম পার্থ। আমাদের কলেজের বন্ধু, আপনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে চায়।“ 
শ্রীবাবাজী সুমধুর কণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ, কর।“ 
প্রণাম করলাম। পায়ে হাত দিয়ে। 
আর পরমুর্তেই একটা বিদ্যুতের চমক। নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমার মনকে, দেহকে। মনে হলো, এ জগত থেকে যেন চলে গেছি অন্য কোনো জগতে। সেখানে নেই কোনো অশান্তি, অতৃপ্তি। কত প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলাম। সব কোথায় হারিয়ে গেল! মনে নেই সময়ের কথা। যখন সম্বিত ফিরলো, দেখলাম, শ্রীবাবাজী একটা বই হাতে নিয়ে তন্ময় হয়ে পাতা ওল্টাচ্ছেন। আর মাঝে মাঝেই গ্রামের লোকেদের সঙ্গে, ভক্তদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন।
 পাঠ শুরু করলেন। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে স্যার আইনস্টাইন এর লেখার প্রসঙ্গ অনায়াসে ওনার মুখে শুনলাম। বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যে কোনো বিরোধ নেই, সেই কথাটা সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন। 
তারপর প্রসাদ পেলাম। কলাপাতায় । গ্রামের লোকজন ও রাধামাধবজী পরিবেশনে লাগলেন। ভাত, ডাল, তরকারী আমের চাটনি। একেই কি অমৃত বলে! 
প্রসাদ পেয়ে শ্রীবাবাজীর ঘরে ঢুকে দেখি, বেশ ভিড়। কেউ পদসেবা করছেন, কেউ বা তার সমস্যার কথা বলছেন। কেউ বসে আছেন লাল মেঝেতে। আমিও বন্ধুদের সঙ্গে বসলাম। বাবা বেশ রসিকতার সঙ্গে দু-চারটি গল্প বললেন। 
এই প্রথম আমি দেখলাম, কারো মুখের হাসি শিশুদের মতো এত সরল হতে পারে। ঘর একটু ফাঁকা হয়ে এল। বাবা পাশ ফিরলেন আমাদের দিকে। ওনার দৃষ্টি আমার দিকে পড়তেই মনে হল, উনি যেন এক্স-রে মেশিনের মতো আমার ভিতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। এতটাই শক্তি তাতে। 
আমি অষ্ফুটে বলে উঠলাম, “বাবা, আমি মন্ত্র নেব।“ 
কিছুই আমি জানতাম না। মন্ত্র কী, নিলে কী হয়, কী করতে হয়। শ্রীবাবাজীকে বললে তিনি তা দেন কি না। মাঝে মাঝে মঠে-মন্দিরে গেছি, কিন্তু এরকম আকর্ষণ আগে কখনো অনুভব করিনি। 
বাবা বললেন, 'আচ্ছা, কাল সকাল ৯ টায় তৈরি থাকিস। মন্ত্র দেব।'
 আমি বললাম, 'বাবা, আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।।' 
বাবা বললেন, 'আচ্ছা, এখন একটু বিশ্রাম কর। অনেক পথ সফর করে এসেছিস। রাত্রে আমায় জানাস।' আমরা উঠে এলাম প্রণাম করে। আমরা মোট চার জন ছিলাম। আমি, সুপ্রদীপ, অয়নেন্দু আর সৌরভ।


আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপর রেললাইনের ধারে দাদাগুরুজীর স্মৃতি মন্দির দর্শন করে সন্ধ্যাবেলা আশ্রমে ফিরলাম। একটু পরেই আরতি শুরু হলো। আসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা। বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আরতি শেষ হলে বাবা বসলেন পাঠে। 
সেই খোলা বারান্দা, সেই খোলা মন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভক্তিময় সেই চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে জ্ঞানের দ্যুতিতে। আমার সঠিক মনে পড়ছে না, কোন গ্রন্থ থেকে বাবা সেদিন পাঠ করছিলেন। কারণ আমি দেখলাম, শ্রীবাবাজীর সামনে বই শুধু খোলাই পড়ে আছে। আসলে উনি সামনে বসে থাকা মানুষগুলির মনের কথা পড়ছিলেন। সেই বইগুলো হয়তো সাজানো-গোছানো নয়, ষড়রিপুর তাপে আধপোড়া। আগামিকাল ২ ভাগ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad